পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৬৭

 মহেন্দ্র সেখান হইতে কোনোমতে উঠিয়া পালাইতে পারিলে বাঁচে, কিন্তু হঠাৎ উঠিতে পারিল না। মার বিছানার প্রান্তে অন্ধকারে নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।

 অনেকক্ষণ পরে রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আজ রাত্রে তো এখানেই আছিস?”

 মহেন্দ্র কহিল, “না।”

 রাজলক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কখন যাবি।”

 মহেন্দ্র কহিল, “এখনই।”

 রাজলক্ষ্মী কষ্টে উঠিয়া বসিয়া কহিলেন, “এখনই? একবার বউমার সঙ্গে ভালো করিয়া দেখাও করিয়া যাবি না?”

 মহেন্দ্র নিরুত্তর হইয়া রহিল। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “এ কয়টা দিন বউমার কেমন করিয়া কাটিয়াছে, তাহা কি তুই একটু বুঝিতেও পারিলি না। ওরে নির্লজ্জ, তোর নিষ্ঠুরতায় আমার বুক ফাটিয়া গেল।”

 বলিয়া রাজলক্ষ্মী ছিন্ন শাখার মতো বিছানায় শুইয়া পড়িলেন।

 মহেন্দ্র মার বিছানা ছাড়িয়া বাহির হইয়া গেল। অতি মৃদুপদে নিঃশব্দগমনে সে সিঁড়ি দিয়া তাহার উপরের শয়নঘরে চলিল। আশার সহিত দেখা হয়, এ তাহার ইচ্ছা ছিল না।

 মহেন্দ্র উপরে উঠিয়াই দেখিল, শয়নগৃহের সম্মুখে যে ঢাকা ছাদ আছে, সেইখানে আশা মাটিতে পড়িয়া। সে মহেন্দ্রের পায়ের শব্দ পায় নাই, হঠাৎ তাহাকে সম্মুখে উপস্থিত দেখিয়া তাড়াতাড়ি কাপড় সারিয়া লইয়া উঠিয়া বসিল। এই সময়ে মহেন্দ্র যদি একটিবার ডাকিত ‘চুনি’— তবে তখনই সে মহেন্দ্রের সমস্ত অপরাধ যেন নিজেরই মাথায় তুলিয়া লইয়া ক্ষমাপ্রাপ্ত অপরাধিনীর মতো মহেন্দ্রের দুই পা জড়াইয়া ধরিয়া তাহার জীবনের সমস্ত কান্নাটা কাঁদিয়া লইত। কিন্তু, মহেন্দ্র সে প্রিয়নাম ডাকিতে পারিল না। যতই চেষ্টা করিল, ইচ্ছা করিল, যতই সে বেদনা পাইল, এ কথা ভুলিতে পারিল না যে, আজ আশাকে আদর করা শূন্যগর্ভ পরিহাসমাত্র। তাহাকে মুখে সান্ত্বনা দিয়া কী হইবে, যখন বিনোদিনীকে পরিত্যাগ করিবার পথ মহেন্দ্র নিজের হাতে একেবারে বন্ধ করিয়া দিয়াছে।

 আশা সংকোচে মরিয়া গিয়া বসিয়া রহিল। উঠিয়া দাঁড়াইতে, চলিয়া যাইতে, কোনোপ্রকার গতির চেষ্টামাত্র করিতে তাহার লজ্জাবোধ হইল। মহেন্দ্র কোনো কথা না বলিয়া ধীরে ধীরে ছাদে পায়চারি করিতে লাগিল। কৃষ্ণপক্ষের আকাশে তখনো চাঁদ ওঠে নাই― ছাদের কোণে একটা ছোটো গামলায় রজনীগন্ধার গাছে দুইটি ডাঁটায় ফুল ফুটিয়াছে। ছাদের উপরকার অন্ধকার আকাশে ঐ