বুঝাইল যে, এতদিন সমস্ত পৃথিবীকে ভুলিয়া সে যাহাকে চাহিয়াছিল আজ তাহাকে পাইয়াছে, আজ উভয়ের মাঝখানে কোনো বাধা নাই; আজ মহেন্দ্রের আনন্দের দিন। কিন্তু কোনো বাধা যে নাই তাহাই সর্বাপেক্ষা বড় বাধা, আজ মহেন্দ্র নিজেই নিজের বাধা।
বিনোদিনী রাস্তা হইতে মহেন্দ্রকে দেখিয়া তাহার ধ্যানাসন হইতে উঠিয়া ঘরে আলো জ্বালিল এবং একটা সেলাই কোলে লইয়া নতশিরে তাহাতে নিবিষ্ট হইল; এই সেলাই বিনোদিনীর আবরণ, ইহার অন্তরালে তাহার যেন একটা আশ্রয় আছে।
মহেন্দ্র ঘরে ঢুকিয়া কহিল, “বিনোদ, এখানে নিশ্চয় তোমার অনেক অসুবিধা ঘটিতেছে।”
বিনোদিনী সেলাই করিতে করিতে বলিল, “কিছুমাত্র না।”
মহেন্দ্র কহিল, “আমি আর দুই-তিন দিনের মধ্যেই সমস্ত আসবাব আনিয়া উপস্থিত করিব, এই কয়দিন তোমাকে একটু কষ্ট পাইতে হইবে।”
বিনোদিনী কহিল, “না, সে কিছুতেই হইতে পারিবে না— তুমি আর একটিও আসবাব আনিয়ো না, এখানে যাহা আছে তাহা আমার আবশ্যকের চেয়ে ঢের বেশি।”
মহেন্দ্র কহিল, “আমি-হতভাগ্যও কি সেই ঢের-বেশির মধ্যে।”
বিনোদিনী। নিজেকে অত বেশি মনে করিতে নাই, একটু বিনয় থাকা ভালো।
সেই নির্জন দীপালোকে কর্মরত নতশির, বিনোদিনীর আত্মসমাহিত মূর্তি দেখিয়া মুহূর্তের মধ্যে মহেন্দ্রের মনে আবার সেই মোহের সঞ্চার হইল।
বাড়িতে হইলে ছুটিয়া সে বিনোদিনীর পায়ের কাছে আসিয়া পড়িত— কি এ তো বাড়ি নহে, সেইজন্য মহেন্দ্র তাহা পারিল না। আজ বিনোদিনী অসহায়, একান্তই সে মহেন্দ্রের আয়ত্তের মধ্যে, আজ নিজেকে সংযত না রাখিলে বড়োই কাপুরুষতা হয়।
বিনোদিনী কহিল, “এখানে তুমি তোমার বই-কাপড়গুলা আনিলে কেন।”
মহেন্দ্র কহিল, “ওগুলাকে যে আমি আমার আবশ্যকের মধ্যেই গণ্য করি। ওগুলা ‘ঢের-বেশি’র দলে নয়।”
বিনোদিনী। জানি, কিন্তু এখানে ওসব কেন।
মহেন্দ্র। সে ঠিক কথা, এখানে কোনো আবশ্যক জিনিস শোভা পায় না—