পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৭৭

বরাবর বিহারী মহেন্দ্রের অন্তরালেই পড়িয়া ছিল। জগতে স্নেহ-প্রেম সম্বন্ধে মহেন্দ্র-দেবতার শুষ্ক নির্মাল্যই তাহার ভাগ্যে জুটিত। আজ মহেন্দ্র স্বয়ং প্রার্থী এবং বিহারী বিমুখ, তবু মহেন্দ্রকে ঠেলিয়া বিনোদিনী এই অরসিক বিহারীকেই বরণ করিল! মহেন্দ্রও বিনোদিনীর দুই-চারিখানা চিঠি পাইয়াছে, কিন্তু বিহারীর এ চিঠির কাছে তাহা নিতান্ত কৃত্রিম, তাহা নির্বোধকে ভুলাইবার শূন্য ছলনা।

 নূতন ঠিকানা জানাইবার জন্য গ্রামের ডাকঘরে মহেন্দ্রকে পাঠাইতে বিনোদিনীর ব্যগ্রতা মহেন্দ্রের মনে পড়িল এবং তাহার কারণ সে বুঝিতে পারিল। বিনোদিনী তাহার সমস্ত মনপ্রাণ দিয়া বিহারীর চিঠির উত্তর পাইবার জন্য পথ চাহিয়া বসিয়া আছে।

 পূর্বপ্রথা-মত মনিব না থাকিলেও ভজু বেহারা মহেন্দ্রকে চা এবং বাজার হইতে জলখাবার আনিয়া খাওয়াইল। মহেন্দ্র স্নান ভুলিয়া গেল। উত্তপ্ত বালুকার উপর দিয়া পথিক যেমন দ্রুতপদে চলে, মহেন্দ্র সেইরূপ ক্ষণে ক্ষণে বিনোদিনীর জ্বালাকর চিঠির উপর দ্রুত চোখ বুলাইতে লাগিল। মহেন্দ্র পণ করিতে লাগিল, বিনোদিনীর সঙ্গে আর কিছুতেই দেখা করিবে না। কিন্তু তাহার মনে হইল, আর দুই-এক দিন চিঠির জবাব না পাইলে বিনোদিনী বিহারীর বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইবে এবং তখন সমস্ত অবস্থা জানিতে পারিয়া সান্ত্বনা লাভ করিবে। সে সম্ভাবনা তাহার কাছে অসহ্য় বোধ হইল।

 তখন চিঠিখানা পকেটে করিয়া মহেন্দ্র সন্ধ্যার কিছু পূর্বে পটলভাঙার বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল।

 মহেন্দ্রের ম্লান অবস্থায় বিনোদিনীর মনে দয়া হইল; সে বুঝিতে পারিল, মহেন্দ্র কাল রাত্রে হয়তো পথে পথে অনিদ্রায় যাপন করিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিল, “কাল রাতে বাড়ি যাও নাই?”

 মহেন্দ্র কহিল, “না।”

 বিনোদিনী ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, “আজ এখনো তোমার খাওয়া হয় নি নাকি।”

 বলিয়া সেবাপরায়ণা বিনোদিনী তৎক্ষণাৎ আহারের আয়োজন করিতে উদ্যত হইল।

 মহেন্দ্র কহিল, “থাক্ থাক্, আমি খাইয়া আসিয়াছি।”

 বিনোদনী। কোথায় খাইয়াছ।

 মহেন্দ্র। বিহারীদের বাড়িতে।