পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭৮
চোখের বালি

 মুহূর্তের জন্য বিনোদিনীর মুখ পাণ্ডুবর্ণ হইয়া গেল। মুহূর্তকাল নিরুত্তর থাকিয়া আত্মসংবরণ করিয়া বিনোদিনী জিজ্ঞাসা করিল, “বিহারী-ঠাকুরপো ভালো আছেন তো?”

 মহেন্দ্র কহিল, “ভালোই আছে। বিহারী যে পশ্চিমে চলিয়া গেল।”

 মহেন্দ্র এমনভাবে বলিল, যেন বিহারী আজই রওনা হইয়াছে।

 বিনোদিনীর মুখ আর-একবার পাংশুবর্ণ হইয়া গেল। পুনর্বার আত্মসংবরণ করিয়া সে কহিল, “এমন চঞ্চল লোকও তো দেখি নাই।― আমাদের সমস্ত খবর পাইয়াছেন বুঝি? ঠাকুরপো খুব কি রাগ করিয়াছেন?”

 মহেন্দ্র। তা না হইলে এই অসহ্য গরমের সময় কি মানুষ শখ করিয়া পশ্চিমে বেড়াইতে যায়।

 বিনোদিনী। আমার কথা কিছু বলিলেন নাকি।

 মহেন্দ্র। বলিবার আর কী আছে। এই লও বিহারীর চিঠি।

 বলিয়া চিঠিখানা বিনোদিনীর হাতে দিয়া মহেন্দ্র তীব্র দৃষ্টিতে তাহার মুখের ভাব নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।

 বিনোদিনী তাড়াতাড়ি চিঠি লইয়া দেখিল, খোলা চিঠি― লেফাফার উপরে তাহারই হস্তাক্ষরে বিহারীর নাম লেখা। লেফাফা হইতে বাহির করিয়া দেখিল, তাহারই লেখা সেই চিঠি। উলটাইয়া-পালটাইয়া কোথাও বিহারীর লেখা জবাব কিছুই দেখিতে পাইল না।

 একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বিনোদিনী মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিল, “চিঠিখানা তুমি পড়িয়াছ?”

 বিনোদিনীর মুখের ভাব দেখিয়া মহেন্দ্রের মনে ভয়ের সঞ্চার হইল। সে ফস্ করিয়া মিথ্যা কথা কহিল, “না।”

 বিনোদিনী চিঠিখানা টুকরা টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া, পুনরায় তাহা কুটিকুটি করিয়া, জানলার বাহিরে ফেলিয়া দিল।

 মহেন্দ্র কহিল, “আমি বাড়ি যাইতেছি।”

 বিনোদিনী তাহার কোন উত্তর দিল না।

 মহেন্দ্র। তুমি যেমন ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছ আমি তাহাই করিব। সাত দিন আমি বাড়িতে থাকিব। কলেজে আসিবার সময় প্রত্যহ একবার এখানকার সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া খেমির হাতে দিয়া যাইব। দেখা করিয়া তোমাকে বিরক্ত করিব না।