পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৮৫

মহেন্দ্র আবার মশারির বহির্ভাগ কোঁচা দিয়া ঝাড়িতে লাগিল। নূতন অভিনেতা রঙ্গভূমিতে প্রবেশের পূর্বে যেমন উৎকণ্ঠার সঙ্গে নেপথ্যদ্বারে দাঁড়াইয়া নিজের অভিনেতব্য বিষয় মনে মনে আবৃত্তি করিয়া দেখিতে থাকে, মহেন্দ্র সেইরূপ মশারির সমুখে দাঁড়াইয়া মনে মনে তাহার বক্তব্য ও কর্তব্য আলোচনা করিতে লাগিল। এমন সময় অত্যন্ত মৃদু একটা শব্দ শুনিয়া মহেন্দ্র মুখ ফিরাইয়া দেখিল, আশা ঘরের মধ্যে নাই।


৪৩

পরদিন প্রাতে মহেন্দ্র মাকে বলিল, “মা, পড়াশুনার জন্য আমার একটি নিরিবিলি স্বতন্ত্র ঘর চাই। কাকীমা যে ঘরে থাকিতেন সেই ঘরে আমি থাকিব।”

 মা খুশি হইয়া উঠিলেন— ‘তবে তো মহিন বাড়িতেই থাকিবে। তবে তো বউমার সঙ্গে মিটমাট হইয়া গেছে। আমার এমন সোনার বউকে কি মহিন চিরদিন অনাদর করিতে পারে। এই লক্ষ্মীকে ছাড়িয়া কোথাকার সেই মায়াবিনী ডাইনিটাকে লইয়া কতদিনই-বা মানুষ ভুলিয়া থাকিবে।’

 মা তাড়াতাড়ি কহিলেন, “তা, বেশ তো মহিন।”

 বলিয়া তখনই চাবি বাহির করিয়া রুদ্ধ ঘর খুলিয়া ঝাড়াঝোড়ার ধুমধাম বাধাইয়া দিলেন।— ‘বউ, ও বউ, বউ কোথায় গেল।’ অনেক সন্ধানে বাড়ির এক কোণ হইতে সংকুচিতা বধূকে বাহির করিয়া আনা হইল।— ‘একটা সাফ জাজিম বাহির করিয়া দাও; এ ঘরে টেবিল নাই, এখানে একটা টেবিল পাতিয়া দিতে হইবে; এ আলো তো এখানে চলিবে না, উপর হইতে তোমার ল্যাম্পটা পাঠাইয়া দাও।’ এইরূপে উভয়ে মিলিয়া এই বাড়িটির রাজাধিরাজের জন্য অন্নপূর্ণার ঘরে বিস্তৃত রাজাসন প্রস্তুত করিয়া দিলেন। মহেন্দ্র সেবাকারিণীদের প্রতি ভ্রূক্ষেপমাত্র না করিয়া গম্ভীরমুখে খাতাপত্রবহি লইয়া ঘরে বসিল এবং সময়ের লেশমাত্র অপব্যয় না করিয়া তৎক্ষণাৎ পড়িতে আরম্ভ করিল।

 সন্ধ্যাবেলায় আহারের পর মহেন্দ্র পুনরায় পড়িতে বসিয়া গেল। সে উপরে তাহার শয়নঘরে শুইবে কি নীচে শুইবে, তাহা কেহ বুঝিতে পারিল না। রাজলক্ষ্মী বহুযত্নে আশাকে আড়ষ্ট পুতুলটির মতো সাজাইয়া কহিলেন, “যাও বউমা, মহিনকে জিজ্ঞাসা করিয়া এসো, তাহার বিছানা কি উপরে হইবে।”

 এ প্রস্তাবে আশার পা কিছুতেই সরিল না, সে নীরবে নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। রুষ্ট রাজলক্ষ্মী তাহাকে তীব্র ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন। আশা বহু কষ্টে