পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৫

বালিকা কোথা হইতে সর্বাঙ্গে রাজ্যের লজ্জা জড়াইয়া আনিয়া পানের বাটা হাতে অনুকুলবাবুর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। তিনি কহিলেন, “লজ্জা কী, মা। বাটা ঐ ওঁদের সামনে রাখো।”

 বালিকা নত হইয়া কম্পিত হস্তে পানের বাটা অতিথিদের আসন-পার্শ্বে ভূমিতে রাখিয়া দিল। বারান্দার পশ্চিমপ্রান্ত হইতে সূর্যাস্ত-আভা তাহার লজ্জিত মুখকে মণ্ডিত করিয়া গেল। সেই অবকাশে মহেন্দ্র সেই কম্পান্বিতা বালিকার করুণ মুখচ্ছবি দেখিয়া লইল।

 বালিকা তখন চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে অনুকুলবাবু কহিলেন, “একটু দাঁড়া, চুনি। বিহারীবাবু, এইটি আমার ছোটাে ভাই অপূর্বর কন্যা। সে তো চলিয়া গেছে, এখন আমি ছাড়া ইহার আর কেহ নাই।”

 বলিয়া তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন।

 মহেন্দ্রের হৃদয়ে দয়ার আঘাত লাগিল। অনাথার দিকে আর-একবার চাহিয়া দেখিল।

 কেহ তাহার বয়স স্পষ্ট করিয়া বলিত না। আত্মীয়েরা বলিত, ‘এই বারোতেরো হইবে।’ অর্থাৎ চোদ্দ-পনেরো হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। কিন্তু অনুগ্রহপালিত বলিয়া একটি কুণ্ঠিত ভীরুভাবে তাহার নব-যৌবনারম্ভকে সংযত সম্বৃত করিয়া রাখিয়াছে।

 আর্দ্রচিত্ত মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার নাম কী।”

 অনুকুলবাবু উৎসাহ দিয়া কহিলেন, “বলো মা, তোমার নাম বলো।”

 বালিকা তাহার অভ্যস্ত আদেশপালনের ভাবে নতমুখে বলিল, “আমার নাম আশালতা।”

 আশা! মহেন্দ্রের মনে হইল নামটি বড়ো করুণ এবং কণ্ঠটি বড়ো কোমল। অনাথ আশা!

 দুই বন্ধু পথে বাহির হইয়া আসিয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল। মহেন্দ্র কহিল, “বিহারী, এ মেয়েটিকে তুমি ছাড়িয়ে না।”

 বিহারী তাহার স্পষ্ট উত্তর না করিয়া কহিল, “মেয়েটিকে দেখিয়া উহার মাসিমাকে মনে পড়ে; বোধ হয় অমনি লক্ষ্মী হইবে।”

 মহেন্দ্র কহিল, “তোমার স্কন্ধে যে বোঝা চাপাইলাম, এখন বোধ হয় তাহার ভার তত গুরুতর বোধ হইতেছে না।”

 বিহারী কহিল, “না, বোধ হয় সহ করিতে পারিব।”