পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮৬
চোখের বালি

ধীরে ধীরে দ্বারের কাছে গেল, কিছুতেই আর অগ্রসর হইতে পারিল না। রাজলক্ষ্মী দূর হইতে বধূর এই ব্যবহার দেখিয়া বারান্দার প্রান্তে দাঁড়াইয়া ক্রুদ্ধ ইঙ্গিত করিতে লাগিলেন। আশা মরিয়া হইয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। মহেন্দ্র পশ্চাতে পদশব্দ শুনিয়া বই হইতে মাথা না তুলিয়া কহিল, “এখনো আমার দেরি আছে― আবার কাল ভোরে উঠিয়া পড়িতে হইবে— আমি এইখানেই শুইব।”

 কী লজ্জা। আশা কি মহেন্দ্রকে উপরের ঘরে শুইতে যাইবার জন্য সাধিতে আসিয়াছিল।

 ঘর হইতে সে বাহির হইতেই রাজলক্ষ্মী বিরক্তির স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হইল কী।”

 আশা কহিল, “তিনি এখন পড়িতেছেন, নীচেই শুইবেন।”

 বলিয়া সে নিজের অপমানিত শয়নগৃহে আসিয়া প্রবেশ করিল। কোথাও তাহার সুখ নাই— সমস্ত পৃথিবী সর্বত্রই যেন মধ্যাহ্নের মরু-ভূতলের মত তপ্ত হইয়া উঠিয়াছে।

 খানিক রাত্রে আশার শয়নগৃহের রুদ্ধ দ্বারে ঘা পড়িল, “বউ, বউ, দরজ খোলা।”

 আশা তাড়াতাড়ি দ্বার খুলিয়া দিল। রাজলক্ষ্মী তাহার হাঁপানি লইয়: সিড়িতে উঠিয়া কষ্টে নিশ্বাস লইতেছিলেন। ঘরে প্রবেশ করিয়াই তিনি বিছানায় বসিয়া পড়িলেন ও বাকশক্তি ফিরিয়া আসিতেই ভাঙা গলায় কহিলেন, “বউ, তোমার রকম কী। উপরে আসিয়া দ্বার বন্ধ করিয়াছ যে! এখন কি এইরকম রাগারাগি করিবার সময়। এত দুঃখেও তোমার ঘটে বুদ্ধি আসিল না! যাও, নীচে যাও।”

 আশা মৃদু স্বরে কহিল, “তিনি একলা থাকিবেন বলিয়াছেন।”

 রাজলক্ষ্মী। একলা থাকিবে বলিলেই হইল! রাগের মুখে সে কী কথা বলিয়াছে, তাই শুনিয়া অমনি বাঁকিয়া বসিতে হইবে! এত অভিমানী হইলে চলে না। যাও, শীঘ্র যাও।

 দুঃখের দিনে বধূর কাছে শাশুড়ির আর লজ্জা নাই। তাঁহার হাতে যে-কিছু উপায় আছে তাহাই দিয়া মহেন্দ্রকে কোনোমতে বাঁধিতেই হইবে।

 আবেগের সহিত কথা কহিতে কহিতে রাজলক্ষ্মীর পুনরায় অত্যন্ত শ্বাসকষ্ট হইল। কতকটা সংবরণ করিয়া তিনি উঠিলেন। আশাও দ্বিরুক্তি না করিয়া তাঁহাকে ধরিয়া লইয়া নীচে চলিল। রাজলক্ষ্মীকে আশা তাঁহার শয়নঘরে বিছানায়