পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮৮
চোখের বালি

 মহেন্দ্র কহিল, “মা, তোমার সেই হাঁপানি কি বাড়িয়াছে।”

 এতদিন পরে এই প্রশ্ন শুনিয়া মার মনে বড়ো অভিমান জন্মিল। বুঝিলেন, বউ গিয়া বলাতেই আজ মহিন মার খবর লইতে আসিয়াছে। এই অভিমানের আবেগে তাঁহার বক্ষ আরো আন্দোলিত হইয়া উঠিল— কষ্টে বাক্য উচ্চারণ করিয়া বলিলেন, “যা, তুই শুতে যা। আমার ও কিছুই না।”

 মহেন্দ্র। না মা, একবার পরীক্ষা করিয়া দেখা ভালো, এ ব্যামো উপেক্ষা করিবার জিনিস নহে।

 মহেন্দ্র জানিত তাহার মাতার হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতা আছে। এই কারণে এবং মাতার মুখশ্রীর লক্ষণ দেখিয়া সে উদ্‌বেগ অনুভব করিল।

 মা কহিলেন, “পরীক্ষা করিবার দরকার নাই, আমার এ ব্যামো সারিবার নহে।”

 মহেন্দ্র কহিল, “আচ্ছা, আজ রাত্রের মতো একটা ঘুমের ওষুধ আনাইয়া দিতেছি, কাল ভালো করিয়া দেখা যাইবে।”

 রাজলক্ষ্মী। ঢের ওষুধ খাইয়াছি, ওষুধে আমার কিছু হয় না। যাও মহিন, অনেক রাত হইয়াছে, তুমি ঘুমাইতে যাও।

 মহেন্দ্র। তুমি একটু সুস্থ হইলেই আমি যাইব।

 তখন অভিমানিনী রাজলক্ষ্মী দ্বারের অন্তরালবর্তিনী বধুকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “বউ, কেন তুমি এই রাত্রে মহেন্দ্রকে বিরক্ত করিবার জন্য এখানে আনিয়াছ।”

 বলিতে বলিতে তাঁহার শাসকষ্ট আরো বাড়িয়া উঠিল

 তখন আশা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে মহেন্দ্রকে কহিল, “যাও, তুমি শুইতে যাও, আমি মার কাছে থাকিব।”

 মহেন্দ্র আশাকে আড়ালে ডাকিয়া লইয়া কহিল, আমি একটা ওষুধ আনাইতে পাঠাইলাম। শিশিতে দুই দাগ থাকিবে— এক দাগ খাওয়াইয়া যদি ঘুম না আসে, তবে এক ঘণ্টা পরে আর এক দাগ খাওয়াইয়া দিয়ো। রাত্রে বাড়িলে আমাকে খবর দিতে ভুলিয়ো না।”

 এই বলিয়া মহেন্দ্র নিজের ঘরে ফিরিয়া গেল। আশা আজ তাহার কাছে যে মূর্তিতে দেখা দিল, এ যেন মহেন্দ্রের পক্ষে নূতন। এ আশার মধ্যে সংকোচ নাই, দীনতা নাই; এই আশা নিজের অধিকারের মধ্যে নিজে অধিষ্ঠিত, সেটুকুর জন্য মহেন্দ্রের নিকট সে ভিক্ষাপ্রার্থিনী নহে! নিজের স্ত্রীকে মহেন্দ্র উপেক্ষা করিয়াছে,