চোখের বালি
১৮৯
কিন্তু বাড়ির বধূর প্রতি তাহার সন্ত্রম জন্মিল।
আশা তাঁহার প্রতি যত্নবশত মহেন্দ্রকে ডাকিয়া আনিয়াছে, ইহাতে রাজলক্ষ্মী মনে মনে খুশি হইলেন। মুখে বলিলেন, “বউমা, তোমাকে শুতে পাঠাইলাম, তুমি আবার মহেন্দ্রকে টানিয়া আনিলে কেন।”
আশা তাহার উত্তর না দিয়া পাখা হাতে তাঁহার পশ্চাতে বসিয়া বাতাস করিতে লাগিল।
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “যাও বউমা, শুতে যাও।”
আশা মৃদুস্বরে কহিল, “আমাকে এইখানে বসিতে বলিয়া গেছেন।”
আশা জানিত, মহেন্দ্র মাতার সেবায় তাহাকে নিয়োগ করিয়া গেছে, এ খবরে রাজলক্ষ্মী খুশি হইবেন।
৪৪
রাজলক্ষ্মী যখন স্পষ্টই দেখিলেন আশা মহেন্দ্রের মন বাঁধিতে পারিতেছে না, তখন তাঁহার মনে হইল, ‘অন্তত আমার ব্যামো উপলক্ষ করিয়াও যদি মহেন্দ্রকে থাকিতে হয় সেও ভালো।’ তাঁহার ভয় হইতে লাগিল, পাছে তাঁহার অসুখ একেবারে সারিয়া যায়। আশাকে ভাঁড়াইয়া ওষুধ তিনি ফেলিয়া দিতে আরম্ভ করিলেন।
অন্যমনষ্ক মহেন্দ্র বড়ো-একটা খেয়াল করিত না। কিন্তু আশা দেখিতে পাইত, রাজলক্ষ্মীর রোগ কিছুই কমিতেছে না, বরঞ্চ যেন বাড়িতেছে। আশা ভাবিত, মহেন্দ্র যথেষ্ট যত্ন ও চিন্তা করিয়া ঔষধ নির্বাচন করিতেছে না— মহেন্দ্রের মন এতই উদ্ভ্রান্ত যে, মাতার পীড়াও তাহাকে চেতাইয়া তুলিতে পারিতেছে না। মহেন্দ্রের এত বড়ো দুর্গতিতে আশা তাহাকে মনে মনে ধিক্কার না দিয়া থাকিতে পারিল না। এক দিকে নষ্ট হইলে মানুষ কি সকল দিকেই এমনি করিয়া নষ্ট হয়।
একদিন সন্ধ্যাকালে রোগের কষ্টের সময় রাজলক্ষ্মীর বিহারীকে মনে পড়িয়া গেল। কত দিন বিহারী আসে নাই তাহার ঠিক নাই। আশাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বউমা, বিহারী এখন কোথায় আছে জান।”
আশা বুঝিতে পারিল, চিরকাল রোগতাপের সময় বিহারীই মার সেবা করিয়া আসিয়াছে। তাই কষ্টের সময় বিহারীকেই মাতার মনে পড়িতেছে। হায়, এই সংসারের অটল নির্ভর সেই চিরকালের বিহারীও দুর হইল! বিহারীঠাকুরপো থাকিলে এই দুঃসময়ে মার যত্ন হইত— ইঁহার মতো তিনি হৃদয়হীন নহেন। আশার হৃদয় হইতে দীর্ঘনিশাস পড়িল।