পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১৯১

 মহেন্দ্র পশ্চাতে পদশব্দ শুনিল। বুঝিল, আশা ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। যেন শুনিতে পায় নাই, এই ভান করিয়া স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। আশা সে ভানটুকু বুঝিতে পারিল, তবু ঘর হইতে চলিয়া গেল না। পশ্চাতে দাঁড়াইয়া কহিল, “একটা কথা আছে, সেইটে বলিয়াই আমি যাইতেছি।”

 মহেন্দ্র ফিরিয়া কহিল, “যাইতে হইবে কেন, একটু বোসোই-না।”

 আশা এই ভদ্রতাটুকুতে কান না দিয়া স্থির দাঁড়াইয়া কহিল, “বিহারীঠাকুরপোকে মার অসুখের খবর দেওয়া উচিত।”

 বিহারীর নাম শুনিয়াই মহেন্দ্রের গভীর হৃদয়ক্ষতে ঘা পড়িল। নিজেকে একটুখানি সামলাইয়া লইয়া কহিল, “কেন উচিত। আমার চিকিৎসায় বুঝি বিশ্বাস হয় না?”

 মহেন্দ্র মাতার চিকিৎসায় যথোচিত যত্ন করিতেছে না, এই ভর্ৎসনায় আশায় হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া ছিল, তাই তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল, “কই, মার ব্যামো তো কিছুই ভালো হয় নাই, দিনে দিনে আরো যেন বাড়িয়া উঠিতেছে।”

 এই সামান্য কথাটার ভিতরকার উত্তাপ মহেন্দ্র বুঝিতে পারিল। এমন গূঢ় ভর্ৎসনা আশা আর কখনোই মহেন্দ্রকে করে নাই। মহেন্দ্র নিজের অহংকারে আহত হইয়া বিস্মিত বিদ্রূপের সহিত কহিল, “তোমার কাছে ডাক্তারি শিখিতে হইবে দেখিতেছি।”

 আশা এই বিদ্রূপে তাহার পুঞ্জীভূত বেদনার উপরে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত আঘাত পাইল; তাহার উপরে ঘর অন্ধকার ছিল, তাই সেই চিরকালের নিরুত্তর আশা আজ অসংকোচে উদ্দীপ্ত তেজের সহিত বলিয়া উঠিল, “ডাক্তারি না শেখ, মাকে যত্ন করা শিখিতে পার।”

 আশার কাছে এমন জবাব পাইয়া মহেন্দ্রের বিস্ময়ের সীমা রহিল না। এই অনভ্যস্ত তীব্র বাক্যে মহেন্দ্র নিষ্ঠুর হইয়া উঠিল। কহিল, “তোমার বিহারীঠাকুরপোকে কেন এই বাড়িতে আসিতে নিষেধ করিয়াছি, তাহা তো তুমি জান— আবার তাহাকে স্মরণ করিয়াছ বুঝি!”

 আশা দ্রুতপদে ঘর হইতে চলিয়া গেল। লজ্জার ঝড়ে যেন তাহাকে ঠেলিয়া লইয়া গেল। লজ্জা তাহার নিজের জন্য নহে। অপরাধে যে ব্যক্তি মগ্ন হইয়া আছে, সে এমন অন্যায় অপবাদ মুখে উচ্চারণ করিতে পারে! এত বড়ো নির্লজ্জতাকে পর্বতপ্রমাণ লজ্জা দিয়াও ঢাকা যায় না।

 আশা চলিয়া গেলেই মহেন্দ্র নিজের সম্পূর্ণ পরাভব অনুভব করিতে পারিল।