পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
২০৭

 শুনিয়া অন্নপূর্ণার চোখ দিয়া ঝর্ ঝর্ করিয়া জল পড়িতে লাগিল। বিহারী ব্যস্ত হইয়া কহিল, “কাকীমা, তোমার এখনো খাওয়া হয় নাই?”

 অন্নপূর্ণা কহিলেন, “না, এখনো আমার সময় হয় নাই।”

 বিহারী কহিল, “চলো, আমি রাঁধিবার জোগাড় করিয়া দিই গে। আজ অনেক দিন পরে তোমার হাতের রান্না এবং তোমার পাতের প্রসাদ খাইয়া বাঁচিব।”

 মহেন্দ্র-আশার সম্বন্ধে বিহারী কোনো কথাই উত্থাপন করিল না। অন্নপূর্ণা একদিন স্বহস্তে বিহারীর নিকটে সে দিক্‌কার দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়াছেন। অভিমানের সহিত সেই নিষ্ঠুর নিষেধ সে পালন করিল।

 আহারান্তে অন্নপূর্ণা কহিলেন, “নৌকা ঘাটেই প্রস্তুত আছে বিহারী, এখন একবার কলিকাতায় চল্।”

 বিহারী কহিল, “কলিকাতায় আমার কোন্ প্রয়োজন।”

 অন্নপূর্ণা কহিলেন, “দিদির বড়ো অসুখ, তিনি তোকে দেখিতে চাহিয়াছেন।”

 শুনিয়া বিহারী চকিত হইয়া উঠিল। জিজ্ঞাসা করিল, “মহিনদা কোথায়।”

 অন্নপূর্ণ। কহিলেন, “সে কলিকাতায় নাই, পশ্চিমে চলিয়া গেছে।”

 শুনিয়া মুহূর্তে বিহারীর মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। সে চুপ করিয়া রহিল।

 অন্নপূর্ণা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুই কি সকল কথা জানিস নে।”

 বিহারী কহিল, “কতকটা জানি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানি না।”

 তখন অন্নপূর্ণা, বিনোদিনীকে লইয়া মহেন্দ্রের পশ্চিমে পলায়নের বার্তা বলিলেন। বিহারীর চক্ষে তৎক্ষণাৎ জল-স্থল-আকাশের সমস্ত রঙ বদলাইয়া গেল, তাহার কল্পনাভাণ্ডারের সমস্ত সঞ্চিত রস মুহূর্তে তিক্ত হইয়া উঠিল।― ‘মায়াবিনী বিনোদিনী কি সেদিনকার সন্ধ্যাবেলায় আমাকে লইয়া খেলা করিয়া গেল। তাহার ভালোবাসার আত্মসমর্পণ সমস্তই ছলনা! সে তাহার গ্রাম ত্যাগ করিয়া নির্লজ্জভাবে মহেন্দ্রের সঙ্গে একাকিনী পশ্চিমে চলিয়া গেল। ধিক্ তাহাকে এবং ধিক্‌ আমাকে যে আমি মূঢ়, তাহাকে এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্বাস করিয়াছিলাম।’

 হায় মেঘাচ্ছন্ন আষাঢ়ের সন্ধ্যা, হায় গতবৃষ্টি পূর্ণিমার রাত্রি, তোমাদের ইন্দ্রজাল কোথায় গেল।