পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২১০
চোখের বালি

 বিহারী কহিল, “মা, তোমার এই পেটুক ছেলেটিকে সকলেই চিনিয়া লইয়াছে। দেউড়িতে ঢুকিতেই দেখি, ডিমওয়ালা বড়ো বড়ো কইমাছ চুপড়িতে লইয়া বামি হন্ হন্ করিয়া অন্দরের দিকে ছুটিয়াছে― বুঝিলাম, এ বাড়িতে এখনো আমার খ্যাতি লুপ্ত হয় নাই।”

 বলিয়া বিহারী হাসিয়া একবার আশার মুখের দিকে চাহিল।

 আশা আজ আর লজ্জা পাইল না। সে মেহের সহিত স্মিতহাস্যে বিহারীর পরিহাস গ্রহণ করিল। বিহারী এ সংসারের কতখানি আশা তাহা আগে সম্পূর্ণ জানিত না― অনেক সময় তাহাকে অনাবশ্যক আগন্তুক মনে করিয়া অবজ্ঞা করিয়াছে, অনেক সময় বিহারীর প্রতি বিমুখ ভাব তাহার আচরণে সুস্পষ্ট পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। সেই অনুতাপের ধিক্‌কারে আজ বিহারীর প্রতি তাহার শ্রদ্ধা এবং করুণা সবেগে ধাবিত হইয়াছে।

 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “মেজবউ, বামুনঠাকুরের কর্ম নয়, রান্নাটা তোমায় নিজে দেখাইয়া দিতে হইবে― আমাদের এই বাঙাল ছেলে একরাশ ঝাল নহিলে খাইতে পারে না।

 বিহারী। তোমার মা ছিলেন বিক্রমপুরের মেয়ে, তুমি নদীয়া জেলার ভদ্রসন্তানকে বাঙালি বল! এ তো আমার সহ্য হয় না।

 ইহা লইয়া অনেক পরিহাস হইল, এবং অনেক দিন পরে মহেন্দ্রের বাড়ির বিষদভার যেন লঘু লইয়া আসিল।

 কিন্তু এত কথাবার্তার মধ্যে কোনো পক্ষ হইতে কেহ মহেন্দ্রের নাম উচ্চারণ করিল না। পূর্বে বিহারীর সঙ্গে মহেন্দ্রের কথা লইয়াই রাজলক্ষ্মীর একমাত্র কথা ছিল। তাহা লইয়া মহেন্দ্র নিজে তাহার মাতাকে অনেকবার পরিহাস করিয়াছে। আজ সেই রাজলক্ষ্মীর মুখে মহেন্দ্রের নাম একবারও না শুনিয়া বিহারী মনে মনে স্তম্ভিত হইল।

 রাজলক্ষ্মীর একটু নিদ্রাবেশ হইতেই বিহারী বাহিরে আসিয়া অন্নপূর্ণাকে কহিল, “মার ব্যামো তো সহজ নহে।”

 অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সে তো স্পষ্টই দেখা যাইতেছে।”

 বলিয়া অন্নপূর্ণা তাঁহার ঘরের জানলার কাছে বসিয়া পড়িলেন।

 অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিলেন, “একবার মহিনকে ডাকিয়া আনিবি না বিহারি? আর তো দেরি করা উচিত হয় না।”

 বিহারী কিছুক্ষণ নিরুত্তরে থাকিয়া কহিল, “তুমি যেমন আদেশ করিবে