পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২০
চোখের বালি

আকাঙ্ক্ষা লইয়া কোন্ পাথরকে ঠেলিতেছে। তাহার হৃদয় রক্তে ভাসিয়া গেল, কিন্তু তাহার অদৃষ্ট সূচ্যগ্রপরিমাণ সরিয়া বসিল না।


৫২

সমস্ত রাত্রি মহেন্দ্র ঘুমায় নাই—ক্লান্তশরীরে ভোরের দিকে তাহার ঘুম আসিল। বেলা আটটা-নয়টার সময় জাগিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিল। গত রাত্রির একটা কোন্ অসমাপ্ত বেদনা ঘুমের ভিতরে ভিতরে যেন প্রবাহিত হইতেছিল। সচেতন হইবা মাত্র মহেন্দ্র তাহার ব্যথা অনুভব করিতে আরম্ভ করিল। কিছুক্ষণ পরেই রাত্রির সমস্ত ঘটনাটা মনে স্পষ্ট জাগিয়া উঠিল। সকালবেলাকার সেই রৌদ্রে, অতৃপ্ত নিদ্রার ক্লান্তিতে সমস্ত জগৎটা এবং জীবনটা অত্যন্ত বিরস বোধ হইল। সংসার-ত্যাগের গ্লানি, ধর্মত্যাগের গভীর পরিতাপ এবং এই উদ্‌ভ্রান্ত জীবনের সমস্ত অশান্তিভার মহেন্দ্র কিসের জন্য বহন করিতেছে। এই মোহাবেশ-শূন্য প্রভাতরৌদ্রে মহেন্দ্রের মনে হইল, সে বিনোদিনীকে ভালোবাসে না। রাস্তার দিকে সে চাহিয়া দেখিল, সমস্ত জাগ্রত পৃথিবী ব্যস্ত হইয়া কাজে ছুটিয়াছে। সমস্ত আত্মগৌরব পঙ্কের মধ্যে বিসর্জন দিয়া একটি বিমুখ স্ত্রীলোকের পদপ্রান্তে অকর্মণ্য জীবনকে প্রতিদিন আবদ্ধ করিয়া রাখিবার যে মূঢ়তা, তাহা মহেন্দ্রের কাছে সুস্পষ্ট হইল। একটা প্রবল আবেগের উচ্ছ্বাসের পর হৃদয়ে অবসাদ উপস্থিত হয়; ক্লান্ত হৃদয় তখন আপন অনুভূতির বিষয়কে কিছুকালের জন্য দূরে ঠেলিয়া রাখিতে চায়। সেইভাবের ভাঁটার সময় তলের সমস্ত প্রচ্ছন্ন পঙ্ক বাহির হইয়া পড়ে, যাহা মোহ আনিয়াছিল তাহাতে বিতৃষ্ণা জন্মে। মহেন্দ্র যে কিসের জন্য নিজেকে এমন করিয়া অপমানিত করিতেছে, তাহা সে আজ বুঝিতে পারিল না। সে বলিল, ‘আমি সর্বাংশেই বিনোদিনীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তবু আজ আমি সর্বপ্রকার হীনতা ও লাঞ্ছনা স্বীকার করিয়া ঘৃণিত ভিক্ষুকের মতো তাহার পশ্চাতে অহোরাত্র ছুটিয়া বেড়াইতেছি; এমনতরো অদ্ভুত পাগলামি কোন্ শয়তান আমার মাথার মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দিয়াছে। বিনোদিনী মহেন্দ্রের কাছে আজ একটি স্ত্রীলোকমাত্র, আর কিছুই নহে; তাহার চারি দিকে সমস্ত পৃথিবীর সৌন্দর্য হইতে, সমস্ত কাব্য হইতে, কাহিনী হইতে, যে-একটি লাবণ্যজ্যোতি আকৃষ্ট হইয়াছিল, তাহা আজ মায়ামরীচিকার মতো অন্তর্ধান করিতেই একটি সামান্য নারীমাত্র অবশিষ্ট রহিল―তাহার কোনো অপূর্বত্ব রহিল না।

 তখন এই ধিক্‌কৃত মোহচক্র হইতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিয়া বাড়ি ফিরিয়া