চোখের বালি
১৯
অন্নপূর্ণা। দিদি, সে কী করিয়া হয়— বিহারীর সঙ্গে কথাবার্তা একপ্রকার পাকা হইয়াছে।
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “সে ভাঙিতে কতক্ষণ?”
বলিয়া বিহারীকে ডাকিয়া কহিলেন, “বাবা, তোমার জন্য ভালো পাত্রী দেখিয়া দিতেছি, এই কন্যাটি ছাড়িয়া দিতে হইবে, এ তোমার যোগ্যই নয়।”
বিহারী কহিল, “না মা, সে হয় না। সে সমস্তই ঠিক হইয়া গেছে।”
তখনই রাজলক্ষ্মী অন্নপূর্ণাকে গিয়া কহিলেন, “আমার মাথা খাও মেজোবউ, তোমার পায়ে ধরি, তুমি বিহারীকে বলিলেই সব ঠিক হইবে।”
অন্নপূর্ণা বিহারীকে কহিলেন, “বিহারী, তোমাকে বলিতে আমার মুখ সরিতেছে না, কিন্তু কী করি বলো। আশা তোমার হাতে পড়িলেই আমি বড়ো নিশ্চিন্ত হইতাম, কিন্তু সব তো জানিতেছই—”
বিহারী। বুঝিয়াছি, কাকী। তুমি যেমন আদেশ করিবে, তাহাই হইবে। কিন্তু আমাকে আর কখনো কাহারো সঙ্গে বিবাহের জন্য অনুরোধ করিয়ো না।
বলিয়া বিহারী চলিয়া গেল। অন্নপূর্ণার চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল, মহেন্দ্রের অকল্যাণ-আশঙ্কায় মুছিয়া ফেলিলেন। বার বার মনকে বুঝাইলেন— যাহা হইল তাহা ভালোই হইল।
এইরূপে রাজলক্ষ্মী, অন্নপূর্ণ এবং মহেন্দ্রের মধ্যে নিষ্ঠুর নিগূঢ় নীরব ঘাতপ্রতিঘাত চলিতে চলিতে বিবাহের দিন সমাগত হইল। বাতি উজ্জ্বল হইয়া জ্বলিল, সানাই মধুর হইয়া বাজিল, মিষ্টান্নে মিষ্টের ভাগ লেশমাত্র কম পড়িল না।
আশা সজ্জিত সুন্দর দেহে, লজ্জিত মুগ্ধ মুখে, আপন নূতন সংসারে প্রথম পদার্পণ করিল; তাহার এই কুলায়ের মধ্যে কোথাও যে কোনো কণ্টক আছে, তাহা তাহার কম্পিত কোমল হৃদয় অনুভব করিল না; বরঞ্চ জগতে তাহার একমাত্র মাতৃস্থানীয়া অন্নপূর্ণার কাছে আসিতেছে বলিয়া আশ্বাসে ও আনন্দে তাহার সর্বপ্রকার ভয় সংশয় দূর হইয়া গেল। বিবাহের পর রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ডাকিয়া কহিলেন, “আমি বলি, এখন বউমা কিছুদিন তাঁর জেঠার বাড়ি গিয়াই থাকুন।”
মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, মা।”
মা কহিলেন, “এবারে তোমার এক্জামিন আছে, পড়াশুনার ব্যাঘাত হইতে পারে।”
মহেন্দ্র। আমি কি ছেলেমানুষ। নিজের ভালোমন্দ বুঝে চলিতে পারি না?
রাজলক্ষ্মী। তা হোক না বাপু, আর একটা বৎসর বৈ তো নয়।