পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৩০
চোখের বালি

কঠিন হইয়া উঠিল।

 সে ভাবটা কাটা গেলে বিহারী কহিল, “পশ্চিমে গিয়া মহিনদার শরীর অনেকটা ভালো হইয়াছে। আজ পথের অনিয়মে সে একটু ম্লান আছে, স্নানাহার করিলেই শুধরাইয়া উঠিবে।”

 রাজলক্ষ্মী তবু মহেন্দ্রের কথা কিছু বলিলেন না; তখন বিহারী কহিল, “মা, মহিনদা বাহিরেই দাঁড়াইয়া আছে, তুমি না ডাকিলে সে তো আসিতে পারিতেছে না।”

 রাজলক্ষ্মী কিছু না বলিয়া দরজার দিকে চাহিলেন। চাহিতেই বিহারী ডাকিল, “মহিনদা, এসো।”

 মহেন্দ্র ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করিল। পাছে হৃৎপিণ্ড হঠাৎ স্তব্ধ হইয়া যায় এই ভয়ে রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রের মুখের দিকে তখনই চাহিতে পারিলেন না। চক্ষু অর্ধনিমীলিত করিলেন। মহেন্দ্র বিছানার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া চমকিয়া উঠিল, তাহাকে কে যেন মারিল।

 মহেন্দ্র মাতার পায়ের কাছে মাথা রাখিয়া পা ধরিয়া পড়িয়া রহিল। স্পন্দনে রাজলক্ষ্মীর সমস্ত শরীর কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিল।

 কিছুক্ষণ পরে অন্নপূর্ণা ধীরে ধীরে কহিলেন, “দিদি, মহিনকে তুমি উঠিতে বলো, নহিলে ও উঠিবে না।”

 রাজলক্ষ্মী কষ্টে বাক্যস্ফুরণ করিয়া কহিলেন, “মহিন, ওঠ্।”

 মহিনের নাম উচ্চারণমাত্র অনেক দিন পরে তাহার চোখ দিয়া ঝর্ ঝর্ করিয়া জল পড়িতে লাগিল। সেই অশ্রু পড়িয়া তাহার হৃদয়ের বেদনা লঘু হইয়া আসিল। তখন মহেন্দ্র উঠিয়া, মাটিতে হাঁটু গাড়িয়া খাটের উপর বুক দিয়া তাহার মার পাশে আসিয়া বসিল। রাজলক্ষ্মী কষ্টে পাশ ফিরিয়া দুই হাতে মহেন্দ্রের মাথা লইয়া তাহার মস্তক আঘ্রাণ করিলেন, তাহার ললাট চুম্বন করিলেন।

 মহেন্দ্র রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “মা, তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়াছি, আমাকে মাপ করো।”

 বক্ষ শান্ত হইলে রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ও কথা বলিস নে মহিন, আমি তোকে মাপ না করিয়া কি বাঁচি। বউমা, বউমা কোথায় গেল।”

 আশা পাশের ঘরে পথ্য তৈরি করিতেছিল— অন্নপূর্ণা তাহাকে ডাকিয়া আনিলেন।