পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৩২
চোখের বালি

 মহেন্দ্রের বক্ষের মধ্যে অস্ত্র উদ্‌বেলিত হইয়া উঠিতেছিল, তাহার মুখে অন্ন উঠিতেছিল না। রাজলক্ষ্মী তাহাকে বারবার বলিতে লাগিলেন, “মহিন, তুই কিছুই খাইতেছিস না কেন। ভালো করিয়া খা, আমি দেখি।”

 বিহারী কহিল, “জানই তো মা, মহিনদা চিরকাল ঐ রকম, কিছুই খাইতে পারে না। বোঠান, ঐ ঘণ্টটা আমাকে আর-একটু দিতে হইবে, বড়ো চমৎকার হইয়াছে।”

 রাজলক্ষ্মী খুশি হইয়া ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “আমি জানি, বিহারী ঐ ঘণ্টটা ভালোবাসে। বউমা, ওটুকুতে কী হইবে, আর-একটু বেশি করিয়া দাও।”

 বিহারী কহিল, “মা, তোমার এই বউটি বড়ো কৃপণ, হাত দিয়া কিছু গলে না।”

 রাজলক্ষ্মী হাসিয়া কহিলেন, “দেখো তো বউমা, বিহারী তোমারই নুন খাইয়া তোমারই নিন্দা করিতেছে।”

 আশা বিহারীর পাতে একরাশ ঘণ্ট দিয়া গেল।

 বিহারী কহিল, “হায়, হায়, ঘণ্ট দিয়াই আমার পেট ভরাইবে দেখিতেছি, আর ভালো ভালো জিনিস সমস্তই মহিনদার পাতে পড়িবে।

 আশা ফিসফিস করিয়া বলিয়া গেল, “নিন্দুকের মুখ কিছুতেই বন্ধ হয় না।”

 বিহারী মৃদুস্বরে কহিল, “মিষ্টান্ন দিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখো, বন্ধ হয় কি না।”

 দুই বন্ধুর আহার হইয়া গেলে রাজলক্ষ্মী অত্যন্ত তৃপ্তিবোধ করিলেন। কহিলেন, “বউমা, তুমি শীঘ্র খাইয়া এসো।”

 রাজলক্ষ্মীর আদেশে আশা খাইতে গেলে তিনি মহেন্দ্রকে কহিলেন, “মহিন, তুই শুইতে যা।”

 মহেন্দ্র কহিল, “এখনই শুইতে যাইব কেন।”

 মহেন্দ্র রাত্রে মাতার সেবা করিবে স্থির করিয়াছিল। রাজলক্ষ্মী কোনোমতেই তাহা ঘটিতে দিলেন না। কহিলেন, “তুই শ্রান্ত আছিস মহিন, তুই শুইতে যা!”

 আশা আহার শেষ করিয়া পাখা লইয়া রাজলক্ষীর শিয়রের কাছে আসিয়া বসিবার উপক্রম করিলে, তিনি চুপি চুপি তাহাকে কহিলেন, “বউমা, মহেন্দ্রের বিছানা ঠিক হইয়াছে কি না দেখো গে, সে একলা আছে।”

 আশা লজ্জায় মরিয়া গিয়া কোনোমতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। কেবল বিহারী এবং অন্নপূর্ণা রহিলেন।

 তখন রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “বিহারী, তোকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। বিনোদিনীর কী হইল বলিতে পারিস? সে এখন কোথায়।”