পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
২১

 মহেন্দ্র উত্তেজিত ভাবেই বলিল, “পরামর্শ কিছু নয় মা, বউকে ঘরের কাজে আমি দাসীর মতো অত খাটিতে দিতে পারিব না।”

 মা তাঁহার উদ্দীপ্ত জালা দমন করিয়া অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ধীরভাবে কহিলেন,”তাঁহাকে লইয়া কী করিতে হইবে।”

 মহেন্দ্র কহিল, “তাহাকে আমি লেখাপড়া শেখাইব।”

 রাজলক্ষ্মী কিছু না কহিয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেলেন ও মুহূর্ত পরে বধুর হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া মহেন্দ্রের সম্মুখে স্থাপিত করিয়া কহিলেন, “এই লও, তোমার বধূকে লেখাপড়া শেখাও।”

 এই বলিয়া অন্নপূর্ণার দিকে ফিরিয়া গলবন্ত্র জোড়করে কহিলেন, “মাপ করো মেজোগিন্নি, মাপ করো। তোমার বোনঝির মর্যাদা আমি বুঝিতে পারি নাই; উহার কোমল হাতে আমি হলুদের দাগ লাগাইয়াছি, এখন তুমি উহাকে ধুইয়ামুছিয়া বিবি সাজাইয়া মহিনের হাতে দাও— উনি পায়ের উপর পা দিয়া লেখাপড়া শিখুন, দাসীবৃত্তি আমি করিব।”

 এই বলিয়া রাজলক্ষ্মী নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া সশব্দে অর্গল বন্ধ করিলেন।

 অন্নপূর্ণা ক্ষোভে মাটির উপরে বসিয়া পড়িলেন। আশা এই আকস্মিক গৃহবিপ্লবের কোনো তাৎপর্য না বুঝিয়া লজ্জায় ভয়ে দুঃখে বিবর্ণ হইয়া গেল। মহেন্দ্র অত্যন্ত রাগিয়া মনে মনে কহিল, ‘আর নয়, নিজের স্ত্রীর ভার নিজের হাতে লইতেই হইবে, নহিলে অন্যায় হইবে।’

 ইচ্ছার সহিত কর্তব্যবুদ্ধি মিলিত হইতেই, হাওয়ার সঙ্গে আগুন লাগিয়া গেল। কোথায় গেল কালেজ, এক্জামিন, বন্ধুকৃত্য, সামাজিকতা; স্ত্রীর উন্নতি সাধন করিতে মহেন্দ্র তাহাকে লইয়া ঘরে ঢুকিল— কাজের প্রতি দৃক্পাত বা লোকের প্রতি ভ্রুক্ষেপমাত্রও করিল না।

 অভিমানিনী রাজলক্ষ্মী মনে মনে কহিলেন, ‘মহেন্দ্র যদি এখন তার বউকে লইয়া আমার দ্বারে হত্যা দিয়া পড়ে, তবু আমি তাকাইব না, দেখি সে তার মাকে বাদ দিয়া স্ত্রীকে লইয়া কেমন করিয়া কাটায়।’

 দিন যায়— দ্বারের কাছে কোনো অনুতপ্তের পদশব্দ শুনা গেল না।

 রাজলক্ষ্মী স্থির করিলেন, ক্ষমা চাইতে আসিলে ক্ষমা করিবেন— নহিলে মহেন্দ্রকে অত্যন্ত ব্যথা দেওয়া হইবে।

 ক্ষমার আবেদন আসিয়া পৌছিল না। তখন রাজলক্ষ্মী স্থির করিলেন, তিনি নিজে গিয়াই ক্ষমা করিয়া আসিবেন। ছেলে অভিমান করিয়া আছে বলিয়া কি