পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩২
চোখের বালি

এবং আবদারের সেই চিঠিখানির জন্য তৃষিত হইয়া ছিলেন।

 বিহারী মহেন্দ্রের চিঠি পাইল। মহেন্দ্র লিখিয়াছে, ‘মা বোধ হয় অনেক দিন পরে জন্মভূমিতে গিয়া বেশ সুখে আছেন।’

 রাজলক্ষ্মী ভাবিলেন, ‘আহা, মহেন্দ্র অভিমান করিয়া লিখিয়াছে। সুখে আছেন! হতভাগিনী মা নাকি মহেন্দ্রকে ছাড়িয়া কোথাও সুখে থাকিতে পারে।’

 “ও বিহারী, তার পর মহিন কী লিখিয়াছে, পড়িয়া শুনা-না বাছা।”

 বিহারী কহিল, “তার পরে কিছুই না, মা।”

 বলিয়া চিঠিখানা মুঠার মধ্যে দলিত করিয়া একটা বহির মধ্যে পুরিয়া ঘরের এক কোণে ধপ্ করিয়া ফেলিয়া দিল।

 রাজলক্ষ্মী কি আর স্থির থাকিতে পারেন। নিশ্চয়ই মহিন মার উপর এমন রাগ করিয়া লিখিয়াছে যে, বিহারী তাঁহাকে পড়িয়া শোনাইল না।

 বাছুর যেমন গাভীর স্তনে আঘাত করিয়া দুগ্ধ এবং বাৎসল্যের সঞ্চার করে, মহেন্দ্রের রাগ তেমনি রাজলক্ষ্মীকে আঘাত করিয়া তাঁহার অবরুদ্ধ বাৎসল্যকে উৎসারিত করিয়া দিল। তিনি মহেন্দ্রকে ক্ষমা করিলেন। কহিলেন, ‘আহা, বউ লইয়া মহিন সুখে আছে, সুখে থাক্—যেমন করিয়া হোক সে সুখী হোক। বউকে লইয়া আমি তাহাকে আর কোনো কষ্ট দিব না। আহা, যে মা কখনো তাহাকে এক দণ্ড ছাড়িয়া থাকিতে পারে না, সেই মা চলিয়া আসিয়াছে বলিয়া মহিন মার ’পরে রাগ করিয়াছে!’

 বারবার তাঁর চোখ দিয়া জল উছলিয়া উঠিতে লাগিল।

 সে দিন রাজলক্ষ্মী বিহারীকে বারবার আসিয়া বলিলেন, “যাও বাবা, তুমি স্নান করো গে যাও। এখানে তোমার বড়ো অনিয়ম হইতেছে।”

 বিহারীরও সে দিন স্নানাহারে যেন প্রবৃত্তি ছিল না, সে কহিল, “মা, আমার মতন লক্ষ্মীছাড়ারা অনিয়মেই ভালো থাকে।”

 রাজলক্ষ্মী পীড়াপীড়ি করিয়া কহিলেন, “না বাছা, তুমি স্নান করিতে যাও।”

 বিহারী সহস্রবার অনুরুদ্ধ হইয়া নাহিতে গেল। সে ঘরের বাহির হইবা মাত্রই রাজলক্ষ্মী বহির ভিতর হইতে তাড়াতাড়ি সেই কুঞ্চিত দলিত চিঠিখানি বাহির করিয়া লইলেন।

 বিনোদিনীর হাতে চিঠি দিয়া কহিলেন, “দেখো তো মা, মহিন বিহারীকে কী লিখিয়াছে।”

 বিনোদিনী পড়িয়া শুনাইতে লাগিল। মহেন্দ্র প্রথমটা মার কথা লিখিয়াছে;