পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
৩৩

কিন্তু সে অতি অল্পই, বিহার যতটুকু শুনাইয়াছিল তাহার অধিক নহে।

 তার পরেই আশার কথা। মহেন্দ্র রঙ্গে রহস্যে আনন্দে যেন মাতাল হইয়া লিখিয়াছে।

 বিনোদিনী একটুখানি পড়িয়া শুনাইয়াই লজ্জিত হইয়া থামিয়া কহিল, “পিসিমা, ও আর কী শুনিবে।”

 রাজলক্ষ্মীর স্নেহব্যগ্র মুখের ভাব এক মূহূর্তের মধ্যেই পাথরের মতো শক্ত হইয়া যেন জমিয়া গেল। রাজলক্ষ্মী একটুখানি চুপ করিয়া রহিলেন; তার পরে বলিলেন, “থাক্।”

 বলিয়া চিঠি ফেরত না লইয়াই চলিয়া গেলেন।

 বিনোদিনী সেই চিঠিখানা লইয়া ঘরে ঢুকিল। ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া বিছানার উপর বসিয়া পড়িতে লাগিল।

 চিঠির মধ্যে বিনোদিনী কী রস পাইল, তাহা বিনোদিনীই জানে। কিন্তু তাহা কৌতুকরস নহে। বারবার করিয়া পড়িতে পড়িতে তাহার দুই চক্ষু মধ্যাহ্নের বালুকার মতো জলিতে লাগিল, তাহার নিশ্বাস মরুভূমির বাতাসের মতো উত্তপ্ত হইয়া উঠিল।

 মহেন্দ্র কেমন, আশা কেমন, মহেন্দ্র-আশার প্রণয় কেমন, ইহাই তাহার মনের মধ্যে কেবলই পাক খাইতে লাগিল। চিঠিখানা কোলের উপর চাপিয়া ধরিয়া, পা ছড়াইয়া, দেয়ালের উপর হেলান দিয়া, অনেকক্ষণ সম্মুখে চাহিয়া বসিয়া রহিল।

 মহেন্দ্রের সে চিঠি বিহারী আর খুঁজিয়া পাইল না।

 সেদিন মধ্যাহ্নে হঠাৎ অন্নপূর্ণা আসিয়া উপস্থিত। দুঃসংবাদের আশঙ্কা করিয়া রাজলক্ষ্মীর বুকটা হঠাৎ কাঁপিয়া উঠিল; কোনো প্রশ্ন করিতে তিনি সাহস করিলেন না, অন্নপূর্ণার দিকে পাংশুবর্ণমুখে চাহিয়া রহিলেন।

 অন্নপূর্ণা কহিলেন, “দিদি, কলিকাতার খবর সব ভালো।”

 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তবে এখানে যে!”

 অন্নপূর্ণ কহিলেন, “দিদি, তোমার ঘরকন্নার ভার তুমি লও’সে। আমার আর সংসারে মন নাই। আমি কাশী যাইব বলিয়া যাত্রা করিয়া বাহির হইয়াছি। তাই তোমাকে প্রণাম করিতে আসিলাম। জ্ঞানে অজ্ঞানে অনেক অপরাধ করিয়াছি, মাপ করিয়ো। আর তোমার বউ—” (বলিতে বলিতে চোখ ভরিয়া উঠিয়া জল পড়িতে লাগিল) “সে ছেলেমানুষ, তার মা নাই, সে দোষী হোক নির্দোষী হোক, সে তোমার।”