৩৪
চোখের বালি
আর বলিতে পারিলেন না।
রাজলক্ষ্মী ব্যস্ত হইয়া তাঁহার স্নানাহারের ব্যবস্থা করিতে গেলেন। বিহারী খবর পাইয়া গদাই ঘোষের চণ্ডীমণ্ডপ হইতে ছুটিয়া আসিল। অন্নপূর্ণাকে প্রণাম করিয়া কহিল, “কাকীমা, সে কি হয়। আমাদের তুমি নির্মম হইয়া ফেলিয়া যাইবে?”
অন্নপূর্ণা অশ্রু দমন করিয়া কহিলেন, “আমাকে আর ফিরাইবার চেষ্টা করিস নে, বেহারি— তোরা সব সুখে থাক্, আমার জন্যে কিছুই আটকাইবে না।”
বিহারী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তার পরে কহিল, “মহেন্দ্রের ভাগ্য মন্দ, তোমাকে সে বিদায় করিয়া দিল।”
অন্নপূর্ণা চকিত হইয়া কহিলেন, “অমন কথা বলিস নে। আমি মহিনের উপর কিছুই রাগ করি নাই। আমি না গেলে সংসারে মঙ্গল হইবে না।”
বিহারী দূরের দিকে চাহিয়া নীরবে বসিয়া রহিল। অন্নপূর্ণা অঞ্চল হইতে এক জোড়া মোটা সোনার বালা খুলিয়া কহিলেন, “বাবা, এই বালাজোড়া তুমি রাখো— বউমা যখন আসিবেন, আমার আশীৰ্বাদ দিয়া তাঁহাকে পরাইয়া দিয়ো।”
বিহারী বালাজোড়া মাথায় ঠেকাইয়া অশ্রু সম্বরণ করিতে পাশের ঘরে চলিয়া গেল।
বিদায়কালে অন্নপূর্ণা কহিলেন, “বেহারি, আমার মহিনকে আর আমার আশাকে দেখিস।”
রাজলক্ষ্মীর হস্তে একখানি কাগজ দিয়া বলিলেন, “শ্বশুরের সম্পত্তিতে আমার যে অংশ আছে, তাহা এই দানপত্রে মহেন্দ্রকে লিখিয়া দিলাম। আমাকে কেবল মাসে মাসে পনেরোটি করিয়া টাকা পাঠাইয়া দিয়ো।”
বলিয়া ভূতলে পড়িয়া রাজলক্ষ্মীর পদধূলি মাথায় তুলিয়া লইলেন এবং বিদায় হইয়া তীর্থোদ্দেশে যাত্রা করিলেন।
৮
আশা কেমন ভয় পাইয়া গেল। এ কী হইল। মা চলিয়া যান, মাসিম চলিয়া যান। তাহদের সুখ যেন সকলকেই তাড়াইতেছে, এবার যেন তাহাকেই তাড়াইবার পালা। পরিত্যক্ত শূন্য গৃহস্থালির মাঝখানে দাম্পত্যের নূতন প্রেমলীলা তাহার কাছে কেমন অসংগত ঠেকিতে লাগিল।
সংসারের কঠিন কর্তব্য হইতে প্রেমকে ফুলের মতো ছিড়িয়া স্বতন্ত্র করিয়া