বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪০
চোখের বালি

ও পুষ্পিত হইয়া উঠিল।

 আশা কহিল, “এলো ভাই, তোমার সঙ্গে একটা-কিছু পাতাই।”

 বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “কী পাতাইবে।”

 আশা গঙ্গাজল বকুলফুল প্রভৃতি অনেকগুলি ভালো ভালো জিনিসের নাম করিল।

 বিনোদিনী কহিল, “ও-সব পুরানো হইয়া গেছে; আদরের নামের আর আদর নাই।”

 আশা কহিল, “তোমার কোনটা পছন্দ।”

 বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “চোখের বালি।”

 শ্রুতিমধুর নামের দিকেই আশার ঝোঁক ছিল, কিন্তু বিনোদিনীর পরামর্শে আদরের গালিটিই গ্রহণ করিল। বিনোদিনীর গলা ধরিয়া বলিল, “চোখের বালি।” বলিয়া হাসিয়া লুটাইয়া পড়িল।

১১

আশার পক্ষে সঙ্গিনীর বড়ো দরকার হইয়াছিল। ভালোবাসার উৎসবও কেবলমাত্র দুটি লোকের দ্বারা সম্পন্ন হয় না— সুখালাপের মিষ্টান্ন বিতরণের জন্য বাজে লোকের দরকার হয়।

 ক্ষুধিতহৃদয়া বিনোদিনীও নববধূর নবপ্রেমের ইতিহাস মাতালের জালাময় মদের মতো কান পাতিয়া পান করিতে লাগিল। তাহার মস্তিষ্ক মাতিয়া শরীরের রক্ত জ্বলিয়া উঠিল।

 নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে মা যখন ঘুমাইতেছেন, দাসদাসীরা এক তলার বিশ্রামশালায় অদৃশ্য, মহেন্দ্র বিহারীর তাড়নায় ক্ষণকালের জন্য কলেজে গেছে এবং রৌদ্রতপ্ত নীলিমার শেষ প্রান্ত হইতে চিলের তীব্র কণ্ঠ অতিক্ষীণ স্বরে কদাচিৎ শুনা যাইতেছে, তখন নির্জন শয়নগৃহে নীচের বিছানার বালিশের উপর আশা তাহার খোলা চুল ছড়াইয়া শুইত এবং বিনোদিনী বুকের নীচে বালিশ টানিয়া উপুড় হইয়া শুইয়া গুন্-গুন্-গুঞ্জরিত কাহিনীর মধ্যে আবিষ্ট হইয়া রহিত, তার কর্ণমূল আরক্ত হইয়া উঠিত, নিশ্বাস বেগে প্রবাহিত হইতে থাকিত।

 বিনোদিনী প্রশ্ন করিয়া করিয়া তুচ্ছতম কথাটি পর্যন্ত বাহির করিত, এক কথা বারবার করিয়া শুনিত, ঘটনা নিঃশেষ হইয়া গেলে কল্পনার অবতারণা করিত— কহিত, “আচ্ছা ভাই, যদি এমন হইত তো কী হইত, যদি অমন হইত তো কী