পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
৪৩

 রাজলক্ষ্মী বেশ জানিতেন, মহেন্দ্রের মত অগ্রাহ করা সহজ নহে। তিনি বিহারীকে ডাকিয়া কহিলেন, “ও বেহারি, তুই একবার মহিনকে বুঝাইয়া বল্। বিপিনের বউ আছে বলিয়াই এই বৃদ্ধবয়সে আমি একটু বিশ্রাম করিতে পাই। পর হউক যা হউক, আপন লোকের কাছ হইতে এমন সেবা তো কখনো পাই নাই।”

 বিহারী রাজলক্ষ্মীকে কোনো উত্তর না করিয়া মহেন্দ্রের কাছে গেল— কহিল, “মহিনদা, বিনোদিনীর কথা কিছু ভাবিতেছ?”

 মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “ভাবিয়া রাত্রে ঘুম হয় না! তোমার বোঠানকে জিজ্ঞাসা করো-না, আজকাল বিনোদিনীর ধ্যানে আমার আর-সকল ধ্যানই ভঙ্গ হইয়াছে।”

 আশা ঘোমটার ভিতর হইতে মহেন্দ্রকে নীরবে তর্জন করিল।

 বিহারী কহিল, “বল কী। দ্বিতীয় বিষবৃক্ষ!’

 মহেন্দ্র। ঠিক তাই। এখন উহাকে বিদায় করিবার জন্য চুনি ছট্‌ফট্, করিতেছে।

 ঘোমটার ভিতর হইতে আশার দুই চক্ষু আবার ভর্ৎসনা বর্ষণ করিল।

 বিহারী কহিল, “বিদায় করিলেও ফিরিতে কতক্ষণ। বিধবার বিবাহ দিয়া দাও—বিষদাঁত একেবারে ভাঙিবে।”

 মহেন্দ্র। কুন্দরও তো বিবাহ দেওয়া হইয়াছিল।

 বিহারী কহিল, “থাক্, ও উপমাটা এখন রাখো। বিনোদিনীর কথা আমি মাঝে মাঝে ভাবি। তোমার এখানে উনি তো চিরদিন থাকিতে পারেন না। তাহার পরে, যে বন দেখিয়া আসিয়াছি সেখানে উহাকে যাবজ্জীবন বনবাসে পাঠানো, সেও বড়ো কঠিন দণ্ড।”

 মহেন্দ্রের সম্মুখে এ পর্যন্ত বিনোদিনী বাহির হয় নাই, কিন্তু বিহারী তাহাকে দেখিয়াছে। বিহারী এটুকু বুঝিয়াছে, এ নারী জঙ্গলে ফেলিয়া রাখিবার নহে। কিন্তু শিখা এক ভাবে ঘরের প্রদীপরূপে জলে, আর-এক ভাবে ঘরে আগুন ধরাইয়া দেয়— সে আশঙ্কাও বিহারীর মনে ছিল।

 মহেন্দ্র বিহারীকে এই কথা লইয়া অনেক পরিহাস করিল। বিহারীও তাহার জবাব দিল। কিন্তু তাহার মন বুঝিয়াছিল, এ নারী খেলা করিবার নহে, ইহাকে উপেক্ষা করাও যায় না।

 রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীকে সাবধান করিয়া দিলেন। কহিলেন, “দেখো বাছা, বউকে লইয়া তুমি অত টানাটানি করিয়ো না। তুমি পাড়াগাঁয়ের গৃহস্থ-ঘরে ছিলে —আজকালকার চালচলন জান না। তুমি বুদ্ধিমতী,ভালো করিয়া বুঝিয়া চলিয়ো।”