পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
৪৭

তাহাকে অন্য সাধারণ পুরুষের মতো জ্ঞান করা! আর-কেহ হইলে তো এতদিনে অগ্রসর হইয়া নানা কৌশলে বিনোদিনীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ আলাপ-পরিচয় করিত। মহেন্দ্র যে তাহার চেষ্টমাত্রও করে নাই, ইহাতেই কি বিনোদিনী তাহার পরিচয় পাই নাই। বিনোদিনী যদি একবার ভালো করিয়া জানে তবে অন্য পুরুষ এবং মহেন্দ্রের প্রভেদ বুঝিতে পারে।

 বিনোদিনীও ছুদিন পূর্বে আক্রোশের সহিত মনে মনে বলিয়াছিল, ‘এতকাল বাড়িতে আছি, মহেন্দ্র যে একবার আমাকে দেখিবার চেষ্টাও করে না! যখন পিসিমার ঘরে থাকি তখন কোনো ছুতা করিয়াও যে মার ঘরে আসে না! এত ঔদাসীন্য কিসের! আমি কি জড়পদার্থ। আমি কি মানুষ না। আমি কি স্ত্রীলোক নই। একবার যদি আমার পরিচয় পাইত, তবে আদরের চুনির সঙ্গে বিনোদিনীর প্রভেদ বুঝিতে পারিত।’

 আশা স্বামীর কাছে প্রস্তাব করিল, “তুমি কলেজে গেছ বলিয়া চোখের বালিকে আমাদের ঘরে আনিব, তাহার পরে বাহির হইতে তুমি হঠাৎ আসিয়া পড়িবে— তা হইলেই সে জব্দ হইবে।”

 মহেন্দ্র কহিল, “কী অপরাধে তাহাকে এতবড়ো কঠিন শাসনের আয়োজন।”

 আশা কহিল, “না, সত্যই আমার ভারি রাগ হইয়াছে। তোমার সঙ্গে দেখা করিতেও তার আপত্তি! প্রতিজ্ঞা ভাঙিব তবে ছাড়িব।”

 মহেন্দ্র কহিল, “তোমার প্রিয়সখীর দর্শনাভাবে আমি মরিয়া যাইতেছি না। আমি অমন চুরি করিয়া দেখা করিতে চাই না।”

 আশা সানুনয়ে মহেন্দ্রের হাত ধরিয়া কহিল, “মাথা খাও, একটি বার তোমাকে এ কাজ করিতেই হইবে। একবার যে করিয়া হোক, তাহার গুমর ভাঙিতে চাই, তার পর তোমাদের যেমন ইচ্ছা তাই করিয়ো।”

 মহেন্দ্র নিরুত্তর হইয়া রহিল। আশা কহিল, “লক্ষ্মীটি, আমার অনুরোধ রাখো।”

 মহেন্দ্রের আগ্রহ প্রবল হইয়া উঠিতেছিল— সেইজন্য অতিরিক্ত মাত্রায় ঔদাসীন্য প্রকাশ করিয়া সম্মতি দিল।

 শরৎকালে স্বচ্ছ নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে বিনোদিনী মহেন্দ্রের নির্জন শয়নগৃহে বসিয়া আশাকে কার্পেটের জুতা বুনিতে শিখাইতেছিল। আশা অন্যমনস্ক হইয়া ঘন ঘন দ্বারের দিকে চাহিয়া গণনায় ভুল করিয়া বিনোদিনীর নিকট নিজের অসাধ্য অপটুত্ব প্রকাশ করিতেছিল।