বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
৭১

 রাজলক্ষ্মী মনে মনে অভিমান করিয়া কহিলেন, “তা যাও। পড়ার ক্ষতি হইলে কেমন করিয়া থাকিবে।”

 যদিও তাঁহার রোগ সারিয়াছে তবু মহেন্দ্র যাইবে শুনিয়া তখনই তিনি নিজেকে অত্যন্ত রুগ্ণ ও দুর্বল বলিয়া কল্পনা করিলেন; বিনোদিনীকে বলিলেন, “দাও তো বাছা, বালিশটা আগাইয়া দাও।”

 বলিয়া বালিশ অবলম্বন করিয়া শুইলেন, বিনোদিনী আস্তে আস্তে তাঁহার গায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল।

 মহেন্দ্র একবার মার কপালে হাত দিয়া দেখিল, তাঁহার নাড়ী পরীক্ষা করিল। রাজলক্ষ্মী হাত ছাড়াইয়া লইয়া কহিলেন, “নাড়ী দেখিয়া তো ভারি বোঝা যায়! তোর আর ভাবিতে হইবে না, আমি বেশ আছি।”

 বলিয়া অত্যন্ত দুর্বলভাবে পাশ ফিরিয়া শুইলেন।

 মহেন্দ্র বিনোদিনীকে কোনোপ্রকার বিদায়সম্ভাষণ না করিয়া রাজলক্ষ্মীকে প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল!

১৯

বিনোদিনী মনে মনে ভাবিতে লাগিল, ‘ব্যাপারখানা কী। অভিমান, না রাগ, না ভয়? আমাকে দেখাইতে চান আমাকে কেয়ার করেন না? বাসায় গিয়া থাকিবেন? দেখি কতদিন থাকিতে পারেন।”

 কিন্তু বিনোদিনীরও মনে মনে একটা অশান্ত ভাব উপস্থিত হইল।

 মহেন্দ্রকে সে প্রতিদিন নানা পাশে বদ্ধ ও নানা বাণে বিদ্ধ করিতেছিল, সে কাজ গিয়া বিনোদিনী যেন এপাশ-ওপাশ করিতে লাগিল। বাড়ি হইতে তাহার সমস্ত নেশা চলিয়া গেল। মহেন্দ্রবর্জিত আশা তাহার কাছে নিতান্তই স্বাদহীন। আশার প্রতি মহেন্দ্রের সোহাগ-যত্ন বিনোদিনীর প্রণয়বঞ্চিত চিত্তকে সর্বদাই আলোড়িত করিয়া তুলিত— তাহাতে বিনোদিনীর বিরহিণী কল্পনাকে যে বেদনায় জাগরূক করিয়া রাখিত তাহার মধ্যে উগ্র উত্তেজনা ছিল। যে মহেন্দ্র তাহাকে তাহার সমস্ত জীবনের সার্থকতা হইতে ভ্রষ্ট করিয়াছে, যে মহেন্দ্র তাহার মতো স্ত্রীরত্নকে উপেক্ষা করিয়া আশার মতে ক্ষীণবুদ্ধি দীনপ্রকৃতি বালিকাকে বরণ করিয়াছে, তাহাকে বিনোদিনী ভালোবাসে কি বিদ্বেষ করে, তাহাকে কঠিন শাস্তি দিবে, না, তাহাকে হৃদয়সমর্পণ করিবে, তাহা বিনোদিনী ঠিক করিয়া বুঝিতে পারে নাই। একটা জ্বালা মহেন্দ্র তাহার অন্তরে জ্বালাইয়াছে; তাহা হিংসার না প্রেমের, না,