মহেন্দ্র বিহারীর বেদনা কল্পনা করিয়া মনে মনে একটু কৌতুকবোধ করিল। মনে মনে কহিল, ‘হতভাগ্য বিহারী! স্ত্রীলোকের ভালোবাসা হইতে বেচারা একেবারে বঞ্চিত।’ বলিয়া নিজের বুকের পকেটের কাছটায় একবার হাত দিয়া চাপ দিল— ভিতর হইতে তিনটে চিঠি খড়্ খড়্ করিয়া উঠিল।
মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “সবাইকে কেমন দেখিলে।”
বিহারী তাহার উত্তর না করিয়া কহিল, “বাড়ি ছাড়িয়া তুমি যে এখানে?”
মহেন্দ্র কহিল, “আজকাল প্রায় নাইট-ডিউটি পড়ে, বাড়িতে অসুবিধা হয়।”
বিহারী কহিল, “এর আগেও তো নাইট-ডিউটি পড়িয়াছে, কিন্তু তোমাকে তো বাড়ি ছাড়িতে দেখি নাই।”
মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “মনে কোনো সন্দেহ জন্মিয়াছে নাকি।”
বিহারী কহিল, “না, ঠাট্টা নয়, এখনই বাড়ি চলো।”
মহেন্দ্র বাড়ি ফিরিবার জন্য উদ্যত হইয়াই ছিল; কিন্তু বিহারীর অনুরোধ শুনিয়া সে হঠাৎ নিজেকে ভুলাইল, যেন বাড়ি যাইবার জন্য তাহার কিছুমাত্র আগ্রহ নাই। কহিল, “সে কি হয় বিহারী। তা হলে আমার বৎসরটাই নষ্ট হইবে।”
বিহারী কহিল, “দেখো মহিনদা, তোমাকে আমি এতটুকু বয়স হইতে দেখিতেছি, আমাকে ভুলাইবার চেষ্টা করিয়ো না। তুমি অন্যায় করিতেছ।”
মহেন্দ্র। কার ’পরে অন্যায় করিতেছি, জজসাহেব!
বিহারী রাগ করিয়া বলিল, “তুমি যে চিরকাল হৃদয়ের বড়াই করিয়া আসিয়াছ, তোমার হৃদয় গেল কোথায়, মহিনদা!”
মহেন্দ্র। সম্প্রতি কালেজের হাসপাতালে।
বিহারী। থামো মহিনদা, থামো। তুমি এখানে আমার সঙ্গে হাসিয়া ঠাট্টা করিয়া কথা কহিতেছ, সেখানে আশা তোমার বাহিরের ঘরে, অন্দরের ঘরে কাঁদিয়া কাঁদিয়া বেড়াইতেছে।
আশার কান্নার কথা শুনিয়া হঠাৎ মহেন্দ্রের মন একটা প্রতিঘাত পাইল। জগতে আর যে কাহারে সুখদুঃখ আছে, সে কথা তাহার নূতন নেশার কাছে স্থান পায় নাই। হঠাৎ চমক লাগিল; জিজ্ঞাসা করিল, “আশা কাঁদিতেছে কী জন্য।”
বিহার বিরক্ত হইয়া কহিল, “সে কথা তুমি জান না, আমি জানি?”
মহেন্দ্র। তোমার মহিনদা সর্বজ্ঞ নয় বলিয়া যদি রাগ করিতেই হয় তো মহিনদার সৃষ্টিকর্তার উপর রাগ করো।
তখন বিহারী যাহা দেখিয়াছিল, তাহা আগাগোড়া বলিল। বলিতে বলিতে