পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৯০
চোখের বালি

পাঠখানা যে কোথায় অদৃপ্ত হইয়াছে, তাহার আর সন্ধান পাইবার জো নাই। তুমি থাকিলে দেখিয়া খুশি হইতে— লেখাপড়া শেখায় অবহেলা করা স্ত্রীলোকের পক্ষে যতদূর কর্তব্য, চুনি তাহা একান্ত মনে পালন করিতেছে।”

 “মহিন, বিহারী কী করিতেছে।”

 মহেন্দ্র কহিল, “নিজের কাজ ছাড়া আর-সমস্তই করিতেছে। নায়েব-গোমস্তায় তাহার বিষয়সম্পত্তি দেখে; কী চক্ষে দেখে তাহা ঠিক বলিতে পারি না। বিহারীর চিরকাল ঐ দশা। তাহার নিজের কাজ পরে দেখে, পরের কাজ সে নিজে দেখে।”

 অন্নপূর্ণা কহিলেন, “সে কি বিবাহ করিবে না, মহিন।”

 মহেন্দ্র একটুখানি হাসিয়া কহিল, “কই, কিছুমাত্র উদযোগ তো দেখি না।”

 শুনিয়া অন্নপূর্ণা হৃদয়ের গোপন স্থানে একটা আঘাত পাইলেন। তিনি নিশ্চয় বুঝিতে পারিয়াছিলেন, তাহার বোনবিকে দেখিয়া, একবার বিহারী আগ্রহের সহিত বিবাহ করিতে উষ্ঠত হইয়াছিল, তাহার সেই উন্মুখ আগ্রহ অন্যায় করিয়া অকস্মাৎ দলিত হইয়াছে। বিহারী বলিয়াছিল, ‘কাকীম, আমাকে আর বিবাহ করিতে কখনো অনুরোধ করিয়ো না। সেই বড়ো অভিমানের কথা অন্নপূর্ণার কানে বাজিতেছিল। তাহার একান্ত অনুগত সেই স্নেহের বিহারীকে তিনি এমন মনভাঙা অবস্থায় ফেলিয়া আসিয়াছিলেন, তাহাকে কোনো সাস্তুনা দিতে পারেন নাই। অন্নপূর্ণ অত্যন্ত বিমর্ষ ও ভীত হইয়া ভাবিতে লাগিলেন, এখনো কি আশার প্রতি বিহারীর মন পড়িয়া আছে।’

 মহেন্দ্র কখনো ঠাট্টার ছলে, কখনো গম্ভীরভাবে, তাহাদের ঘরকন্নার আধুনিক সমস্ত খবর-বার্তা জানাইল, কেবল, বিনোদিনীর কথার উল্লেখমাত্র করিল না।

 এখন কালেজ খোলা, কাশীতে মহেন্দ্রের বেশি দিন থাকিবার কথা নয়। কিন্তু কঠিন রোগের পর স্বাস্থ্যকর আবহাওয়ার মধ্যে গিয়া আরোগ্যলাভের যে স্থখ, মহেন্দ্র কাশীতে অন্নপূর্ণার নিকটে থাকিয়া প্রতিদিন সেই মুখ অনুভব করিতেছিল— তাই একে একে দিন কাটিয়া যাইতে লাগিল। নিজের সঙ্গে নিজের যে একটা বিরোধ জন্মিবার উপক্রম হইয়াছিল, সেটা দেখিতে দেখিতে দূর হইয়া গেল। কয়দিন সর্বদা ধর্মপরায়ণ অন্নপূর্ণার স্নেহমুখচ্ছবির সম্মুখে থাকিয়া, সংসারের কর্তব্যপালন এমনি সহজ ও স্বখকর মনে হইতে লাগিল যে, তাহার পূর্বেকার আতঙ্ক হাস্তকর বোধ হইল। মনে হইল, বিনোদিনী কিছুই না। এমন-কি, তাহার মুখের চেহারাই মহেন্দ্র স্পষ্ট করিয়া মনে আনিতে পারে না। অবশেষে মহেন্দ্র খুব জোর করিয়াই মনে মনে কহিল, ‘মাশাকে আমার হৃদয় হইতে এক চুল সরাইয়া বসিতে