পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাভাষার স্বাভাবিক ছন্দ
১৭১

দ্বিতীয় ছত্রের ‘তারে’ নামক অতিরিক্ত শব্দটি[১] ছাড়িয়া দিলে দুই ছত্রে এগারটি করিয়া অক্ষর থাকে। কিন্তু উহাই আধুনিক ছন্দে পরিণত করিতে হইলে নিম্নলিখিতরূপ হয়।

মনের কি দোষ আছে,
যেমন নাচাও নাচে।[২]

ইহাতে দুই ছত্রে আটটি অক্ষর হয়; তাল ঠিক সমান রহিয়াছে অথচ অক্ষর কম পড়িতেছে। তাহার কারণ শেষোক্ত ছন্দে আমরা হসন্ত শব্দকে আমল দিই না। বাস্তবিক ধরিতে গেলে রামপ্রসাদের ছন্দেও আটটির অধিক অক্ষর নাই।

মন্বেচারি র্কি দোষাছে,
যেমন্নাচা তেম্নি নাচে।[৩]

দ্বিতীয় ছত্র হইতে ‘নাচাও’ শব্দের ‘ও’ অক্ষর ছাড়িয়া দিয়াছি; তাহার কারণ এই ও-টি হসন্ত ও, পরবর্তী তে-র সহিত ইহা যুক্ত।[৪]

 উপরে দেখাইলাম বাংলা ভাষার স্বাভাবিক ছন্দ কী।[৫] আর, যদি কখনো স্বাভাবিক দিকে বাংলা ছন্দের গতি হয় তবে ভবিষ্যতের ছন্দ রামপ্রসাদের ছন্দের অনুযায়ী হইবে।[৬]

 ভারতী- ১২৯০ শ্রাবণ
  1. এ-রকম ‘অতিরিক্ত শব্দ’কে আধুনিক ছন্দ-পরিভাষায় বলা হয় ‘অতিপর্ব’।
  2. তুলনীয়: বারি ঝরে ঝরঝর... পৃ ৫০, রূপরসে ডুব দিনু... পৃ ৮৬।
  3. তুলনীয়: অচিণ্ডাকে নদীর্বাঁকে...পৃ ১৩৯, এপার্গঙ্গা ওপার্গঙ্গ।... পৃ ১৪৩।
  4. হসন্ত মানে ব্যঞ্জনান্ত। সুতরাং স্বরবর্ণ হসন্ত হতে পারে না। ‘হসন্ত ও’ বলার উদ্দেশ্য এই স্বরবর্ণ টির স্বাতন্ত্র্য নেই, হসন্তবর্ণের মতো অন্য বর্ণের আশ্রিত। অই আই অও আও প্রভৃতি যুগ্মস্বর (diphthong) মাত্রেরই শেষাংশ স্বাতন্ত্র্যহীন। ‘দাও’ শব্দের ‘ও’ স্বাতন্ত্র্যহীন, কিন্তু ‘দিও’ শব্দের ‘ও’ তা নয়। স্বাতন্ত্র্যহীন আশ্রিত স্বরকে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন ‘ভাংটা’ স্বর (ছন্দ-সরস্বতী: ভারতী ১৩২৫ বৈশাখ পৃ ১১)।
  5. তুলনীয়: ভাষার নিজের অন্তরের ‘স্বাভাবিক’ সুর পৃ ৭, রামপ্রসাদের পদে ‘আপন স্বভাবে’ প্রকাশ পেয়েছে পৃ ৫১, বাংলাভাষার ‘স্বকীয়’ ধ্বনিরূপ পৃ ১২৮, বাংলার ‘স্বাভাবিক’ ধ্বনিরূপ পৃ ১৩২, বাংলা শব্দের ‘স্বাভাবিক’ হসন্তরূপ পৃ ১৩৮ ইত্যাদি। এ-বিষয়ের বিস্তৃত আলোচনা “রবীন্দ্রনাথ ও লৌকিক ছন্দ” প্রবন্ধে (বিশ্বভারতী পত্রিকা ১৩৫১ শ্রাবণ-আশ্বিন) দ্রষ্টব্য।
  6. তুলনীয়: এই খাঁটি বাংলায় সকল রকম ছন্দেই সকল কাব্যই লেখা সম্ভব এই আমার বিশ্বান পৃ ১৩০।