পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭২

বাংলা শব্দ ও ছন্দ

 বাংলা শব্দ উচ্চারণের মধ্যে কোথাও ঝোঁক[১] নাই, অথবা যদি থাকে সে এত সামান্য যে, তাহাকে নাই বলিলেও ক্ষতি হয় না। এইজন্যই আমাদের ছন্দে অক্ষর গনিয়া মাত্রা নিরূপিত হইয়াছে। কথার প্রত্যেক অক্ষরের মাত্রা সমান। কারণ কোনো স্থানে বিশেষ ঝোঁক না থাকাতে অক্ষরের বড়ো ছোটো প্রায় নাই। সংস্কৃত উচ্চারণে যে দীর্ঘহ্রস্বের নিয়ম আছে তাহাও বাংলায় লোপ পাইয়াছে। এই কারণে উচ্চারণ-হিসাবে বাংলাভাষা বঙ্গদেশের সমতল-প্রসারিত প্রান্তরভূমির মতো সর্বত্র সমান।[২] জিহ্বা কোথাও বাধা না পাইয়া ভাষার উপর দিয়া যেন একপ্রকার নিদ্রিত অবস্থায় চলিয়া যায়; কথাগুলি চিত্তকে পদে পদে প্রতিহত করিয়া অবিশ্রাম মনোযোগ জাগ্রত করিয়া রাখিতে পারে না।[৩] শব্দের সহিত শব্দের সংঘর্ষণে যে বিচিত্র সংগীত উৎপন্ন হয় তাহা সাধারণত বাংলা ভাষায় অসম্ভব; কেবল একতান কলধ্বনি ক্রমে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের চেতনা লোপ করিয়া দেয়।[৪] একটি শব্দের সম্পূর্ণ অর্থ হৃদয়ংগম হইবার পূর্বেই অবিলম্বে আর-একটি কথার উপরে স্খলিত হইয়া পড়িতে হয়। বৈষ্ণর কবির একটি গান আছে—

মন্দপবন, কুঞ্জভবন,
কুসুমগন্ধ-মাধুরী।

  1. এই প্রসঙ্গের বিস্তৃত আলোচনা ‘বাংলা ছন্দ’ নামক প্রথম প্রবন্ধে দ্রষ্টব্য।
  2. তুলনীয়: বাংলা দেশটি যেমন সমভূমি... পৃ. ৩, সমতল বাংলা আপন কাব্যের ভাষাকে সমতল করে দিয়েছে পৃ ৪৮।
  3. তুলনীয়: মন চলে যায় ঘুমিয়ে পড়া গাড়োয়ানকে নিয়ে রাতের বেলার গোরুর গাড়ির মতো পৃ ১২৩-২৪।
  4. এই উক্তি সাধু বা সংস্কৃত বাংলার সম্বন্ধে প্রযোজ্য, চলতি বা প্রাকৃত বাংলার সম্বন্ধে নয়। প্রাকৃত-বাংলার প্রকৃতি সমতল নয় এবং তাতে শব্দের সংঘাতজাত সংগীতবৈচিত্র্যও আছে, একথা বহুস্থলেই বলা হয়েছে। দ্রষ্টব্য পৃ ৬-৮, ১৭-১৮, ৪৯-৫১ ইত্যাদি।