পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিবিধ
১৮৫

গুমর রাখে না। অথচ এই ছড়ার সঙ্গে ব্যবহার করতে গিয়ে দেখা গেল যেটাকে মনে হয় সহজ সেটাই সবচেয়ে কম সহজ।

 ছড়ার ছন্দকে চেহারা দিয়েছে প্রাকৃত-বাংলা শব্দের চেহারা। আলোর স্বরূপ সম্বন্ধে আধুনিক বিজ্ঞানে দুটো উলটো কথা বলে। এক হচ্ছে আলোর রূপ ঢেউএর রূপ, আর হচ্ছে সেটা কণাবৃষ্টির রূপ। বাংলা সাধুভাষার রূপ ঢেউএর, বাংলা প্রাকৃত ভাষার রূপ কণাবৃষ্টির। সাধুভাষার শব্দগুলি গায়ে গায়ে মিলিয়ে গড়িয়ে চলে, শব্দগুলির ধ্বনি স্বরবর্ণের মধ্যবর্তিতায় আঁট বাঁধতে পারে না।[১] দৃষ্টান্ত যথা—

শমন-দমন রাবণ রাজা, রাবণ-দমন রাম।[২]

বাংলা প্রাকৃতভাষায় হসন্তপ্রধান ধ্বনিতে ফাঁক বুজিয়ে শব্দগুলিকে নিবিড় করে দেয়। পাতলা, আঁজলা, বাদলা, পাপড়ি, চাঁদনি প্রভৃতি নিরেট শব্দগুলি সাধুভাষার ছন্দে গুরুপাক। সাধুভাষার ছন্দে ভদ্র বাঙালি চলতে পারে না, তাকে চলিতে হয়, বসতে তার নিষেধ, বসিতে সে বাধ্য।[৩]

 ছড়ার ছন্দটি যেমন ঘেঁষাঘেঁষি শব্দের জায়গা, তেমনি সেইসব ভাবের উপযুক্ত—যারা অসতর্ক চালে ঘেঁষাঘেঁষি করে রাস্তায় চলে, যারা পদাতিক, যারা রথচক্রের মোটা চিহ্ন রেখে যায় না পথে পথে, যাদের হাটে মাঠে যাবার পায়ে-চলার চিহ্ন ধুলোর উপর পড়ে আর লোপ পেয়ে যায়।

 ছড়ার ছবি, ভূমিকা— ১৩৪৪ আশ্বিন


বাংলা ছন্দে স্বরবর্ণ

 স্বরবর্ণের কোঠায় আমরা ঋ-কে ঋণস্বরূপে নিয়েছি বর্ণমালায়, কিন্তু উচ্চারণ করি ব্যঞ্জনবর্ণের রি। সেইজন্যে অনেক বাঙালি ‘মাতৃভূমি’কে বলেন ‘মাত্রিভূমি’। যে-কবি তাঁর ছন্দে ঋ-কারকে স্বরবর্ণরূপে ব্যবহার করেন তাঁর ছন্দে ঐ বর্ণে অনেকের রসনা ঠোকর খায়।[৪]


  1. দ্রষ্টব্য পৃ ৬, ১৩৯।
  2. কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড।
  3. দ্রষ্টব্য পৃ ৬, ৭৪। এই প্রসঙ্গটি ‘ছন্দের হসন্ত-হলন্ত’ প্রবন্ধে বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। তুলনীয়: ‘টোটকা এই মুষ্টিযোগ..’ পৃ ৬০, ‘ছুটল কেন...’ পৃ ৭৬ ইত্যাদি।
  4. বস্তুত ঋ-কার বাংলাছন্দে বিকল্পে স্বরবর্ণ বলে গণ্য হয়ে থাকে। গ্রন্থপরিচয় দ্রষ্টব্য।