পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৭২
ছন্দ

মানে সিলেবিক। তার পরেই আছে, ‘বস্তুত সাধুভাষার পয়ারও মাত্রাগোনা’। এখানে মাত্রা মানে অক্ষর। এই দুই উক্তির অভিপ্রায় এই যে,—চলতি ভাষার পয়ার এবং সাধু ভাষার পয়ার দুই-ই মাত্রাগোনা, তবে সাধু ভাষার পয়ার অক্ষরগোনা এবং চলতি ভাষার পয়ার সিলেব্‌ল্‌গোনা। সাধু ছন্দের মাত্রা অক্ষর, অ-সাধু ছন্দের মাত্রা সিলেব্‌ল্‌। ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ ইত্যাদি ছড়াটার যে বিশ্লেষণ আছে (পৃ ১৪৩), তাতেও এ কথা প্রতিপন্ন করাই অভিপ্রায়। ‘মন বেচারির কি দোষ আছে’ ইত্যাদি দৃষ্টান্তটির (পৃ ১৭০-৭১) বিশ্লেষণেও ওই একই অভিপ্রায় প্রকাশ পেয়েছে।

এই ভালো রে ফুলের সঙ্গে আলোয় জাগা, গান-গাওয়া এই ভাষায়,
তারার সাথে নিশীথ-রাতে ঘুমিয়ে-পড়া নূতন প্রাতের আশায়।

এই দৃষ্টান্তটি সম্বন্ধে বলা হয়েছে,—“এই জাতের সাধু ছন্দে আঠার অক্ষরের আসন থাকে। কিন্তু এটাতে কোনো কোনো লাইনে পঁচিশ পর্যন্ত উঠেছে” (পৃ ১৮৯)। অক্ষরসংখ্যা কোনো কোনো লাইনে একুশ পর্যন্ত নেমেছে। অর্থাৎ এটা অক্ষরগোনা সাধু ছন্দ নয়। সাধু ছন্দ হলে এটাতে থাকত আঠার অক্ষর; কিন্তু এখানে আছে আঠার সিলেব্‌ল্ (গাওয়া দুই সিলেব্‌ল্‌, ‘ওয়া’র উচ্চারণরূপ wã বা वा; ‘ঘুমিয়ে’ও দুই সিলেব্‌ল্, তার উচ্চারণ ঘুম্‌য়ে)। সাধু ছন্দের মাত্রা অক্ষর, অ-সাধু ছন্দের মাত্রা সিলেব্‌ল্। এটা হচ্ছে অক্ষরমাত্রিক সাধু দীর্ঘপয়ারের সিলেব্‌ল্‌মাত্রিক অ-সাধু প্রতিরূপ। আর, ‘যুদ্ধ যখন সাঙ্গ হল’ ইত্যাদি দৃষ্টান্তটি (পৃ ১৩১) হল চোদ্দ অক্ষরমাত্রার সাধু হ্রস্বপয়ারের অ-সাধু প্রতিরূপ। অধিকন্তু এই দুই দৃষ্টান্তের দুই রকম পয়ারই প্রবহমান। আসল কথা এই যে, এই দুই দৃষ্টান্তে সিলেব্‌ল্ই ছন্দের মাত্রা, অক্ষর বা কলা নয়। ছন্দপরিভাষায় এ দুটি হচ্ছে প্রবহমান দলমাত্রিক (দীর্ঘ ও হ্রস্ব) পয়ারের দৃষ্টান্ত।