পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৮২
ছন্দ

 ‘শরদচন্দ পবনমন্দ’ এবং ‘মন্দপবন কুঞ্জভবন’ ইত্যাদি রচনা দুটি (পৃ ৩৫, ১৭২) ছয়কলা-পর্বের দৃষ্টান্ত। এ-দুটির মাত্রাগণনাপদ্ধতি উপরের দৃষ্টান্তটির অনুরূপ। সুতরাং বিশ্লেষণ অনাবশ্যক। বলা প্রয়োজন যে, গীতগোবিন্দ কাব্যে এ-রকম ছয়কলা-পর্বের দৃষ্টান্ত নেই।

 বৈষ্ণব পদাবলীর প্রাচীন মাত্রাবৃত্ত ছন্দে আ ঈ প্রভৃতি দীর্ঘস্বরের দীর্ঘ উচ্চারণ রক্ষার প্রয়াস দেখা যায়। কিন্তু এ-রকম দীর্ঘতা বাংলার স্বভাবিক উচ্চারণ-বিরোধী। এইজন্যই পদাবলী সাহিত্যে এ বিষয়ে এত ঘন ঘন স্খলনও দেখা যায়। তথাপি পদাবলীতে যে জয়দেবী পদ্ধতিতে স্বরবর্ণের দীর্ঘতা বহুলপরিমাণে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল তার কারণ ওগুলি গান। গানের সুরে স্বরবর্ণের দীর্ঘতা অস্বাভাবিক বলে বোধ হয় না; কিন্তু পঠনীয় কবিতায় ভাষার স্বাভাবিক উচ্চারণ-সম্মত বাক্‌ছন্দকে মেনে চলতে হয়। এইজন্য আধুনিক কালের পঠনীয় কবিতায় জয়দেবী মাত্রাবৃত্ত রীতি একেবারেই পরিত্যক্ত হয়েছে। আর এইজন্যই জয়দেবী মাত্রাবৃত্তের পুনঃপ্রবর্তনও এখন আর সম্ভব নয় (পৃ ২০১-০২)। কেননা তা হবে বাংলা ভাষার ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ সুতরাং ‘কৃত্রিম’; তথাপি এই কৃত্রিমতাকেই যদি চালাতে চেষ্টা করা হয় তবে রবীন্দ্রনাথ়ের মতে সেটা হবে ‘জবরদস্তি’ বা ‘অত্যাচার’ (পৃ ২০০)। অবশ্য তিনি নিজেও কয়েকটি রচনায় জয়দেবী মাত্রাবৃত্ত রীতির আশ্রয় নিয়েছেন, যেমন জনগণমনঅধিনায়ক। কিন্তু সেগুলি গান। জয়দেবী রীতির ছন্দে সর্বভারতীয়তার স্বাদ আছে। জনগণমন গানটিকে সর্বভারতীয় রূপ দেবার প্রয়োজন ছিল। তাই এটিতে জয়দেবী রীতির ছন্দ তথা বহুলপরিমাণ সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ করা হয়েছে (পৃ ২০০)।

 আধুনিক কালের পঠনীয় কবিতায় জয়দেবী মাত্রাবৃত্ত রীতি পরিত্যক্ত হল বটে, কিন্তু মাত্রাবৃত্তসুলভ সংগীতমাধুর্য থেকেও বাংলা সাহিত্য