পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০০
ছন্দ

বিচার ছন্দের শ্রেণীবিভাগের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক নয়। একই ভাষারীতিতে বিভিন্ন প্রকৃতির ছন্দ রচিত হতে পারে এবং একই প্রকৃতির ছন্দ বিভিন্ন ভাষারীতিতে রচনা করা যায়। এই গ্রন্থেও তার দৃষ্টান্ত আছে। যথা——‘বেণীবদ্ধ তরঙ্গিত কোন্ ছন্দ নিয়া’ (পৃ ৬৮), ‘ভ্রূকুটিপ্রচ্ছন্ন চক্ষু কটাক্ষিয়া চায়’ (পৃ ৭০) এবং ‘ছুট্‌ল কেন মহেন্দ্রের আনন্দের ঘোর’ (পৃ ৭৬), এই দৃষ্টান্ত-তিনটির ছন্দোরীতি এক, কিন্তু ভাষারীতি বিভিন্ন—প্রথম দুটি সাধু, তৃতীয়টি চলতি।[১] পক্ষান্তরে ‘সন্ধ্যা-আলোর মেঘের ঝালর ঢাকল অন্ধকারে’ (পৃ ৭৬) এবং ‘শুক্লরাতি ঢাক্‌ল মুখ মেঘাবগুণ্ঠনে’ (পৃ ৭৬) একই ভাষারীতিতে রচিত, কিন্তু এ দুটির ছন্দোরীতি এক নয়। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, কোনো ছন্দোরীতিতেই অবিমিশ্র সাধু বাংলা চলে না, সর্বদাই সাধু বাংলার সঙ্গে চলতি বাংলার মিশ্রণ ঘটে থাকে। তবে সমস্ত রীতির ছন্দেই বিশুদ্ধ চলতি বাংলা চালানো সম্ভবপর (পৃ ১৩০)। তা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে রচনা দেখে তার ভাষারীতি নির্ণয় করা যায় না; কিন্তু মাত্রাসমাবেশপ্রণালী দেখে তার ছন্দোরীতি নির্ণয় করা যায়। যেমন—‘দিগ্‌বলয়ে নবশশিলেখা’ (পৃ ৮০) এবং ‘বউ কথা কও, বউ কথা কও, যতই গায় সে পাখি’ (পৃ ৮৩), এ দুটি রচনা দেখে তার ভাষারীতি ঠিক করা যায় না, কিন্তু মাত্রাস্থাপনপদ্ধতির প্রতি লক্ষ্য করলে ছন্দোরীতি সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ থাকে না। শুধু ভাষা দেখে ছন্দের রীতি নির্ণয় করলে অনেক সময় ভুল করা হবে। যেমন—‘অধীর বাতাস এল সকালে’, ‘নবারুণ চন্দনের তিলকে’ (পৃ ৭৩), ‘শ্রাবণের কালো ছায়া, ‘বর্ষার তমিস্রচ্ছায়া’ (পৃ ১২১), ইত্যাদি রচনার ভাষারীতি দেখে এগুলিকে চলতি বাংলার ছন্দ বললে ভুল করা হবে।

  1. চলতি রীতির ভাষায় সাধুছন্দের অনেক দৃষ্টান্ত আছে পরিশেষ ও পুনশ্চ কাব্যে। যথা—প্রাণ (পরিশেষ) এবং খ্যাতি (পুনশ্চ, দ্বিতীয় সংস্করণ)।