পাতা:ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৬
ছন্দ

এখানে ‘এই’ ‘সেই’ ‘কই’ ‘যায়’ ‘হায়’ প্রভৃতি শব্দ এক সিলেব্‌ল্‌এর বেশি মান দাবি করলে না। বাঙালি পাঠক সেটাকে অন্যায় না মনে করে সহজ ভাবেই নিলে।

কাঁধে মই, বলে, “কই ভুঁইচাপা গাছ।”
দইভাঁড়ে ছিপ ছাড়ে, খোঁজে কইমাছ।
ঘুঁটেছাই মেখে লাউ রাঁধে ঝাউপাতা,
কী খেতাব দেব তায় ঘুরে যায় মাথা।

এখানে ‘সই’ ‘কই’ ‘ভূঁই’ ‘দই’ ‘ছাই’ ‘লাউ’ প্রভৃতি সকলেরই সমান দৈর্ঘ্য, যেন গ্র্যানেডিয়ারের সৈন্যদল। যে-পাঠক এটা পড়ে দুঃখ পাননি সেই পাঠককেই অনুরোধ করি, তিনি পড়ে দেখুন—

দুইজনে জুঁই তুলতে যখন
গেলেম বনের ধারে,
সন্ধ্যা-আলোর মেঘের ঝালর
ঢাকল অন্ধকারে।
কুঞ্জে গোপন গন্ধ বাজায়
নিরুদ্দেশের বাঁশি,
দোঁহার নয়ন খুঁজে বেড়ায়
দোঁহার মুখের হাসি।

এখানে যুগ্মধ্বনিগুলো এক সিলেব ল এর চাকার গাড়িতে অনায়াসে ধেয়ে চলেছে। চণ্ডীদাসের গানে রাধিকা বলেছেন “কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো”। বাঁশিধ্বনির এই তো ঠিক পথ, নিয়মের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করলে মরমে পৌঁছত না। কবিরাও সেই কান লক্ষ্য করে চলেন, নিয়ম যদি চৌমাথার পাহারাওয়ালার মতো সিগ ন্যাল তোলে তবু তাঁদের রুখতে পারে না।

 আমার দুঃখ এই, তথাচ আইনবিৎ বলছেন যে, লিপিপদ্ধতির দোষে ‘অক্ষর গুনে ছন্দরচনার অন্ধ অভ্যাস’ আমাদের পেয়ে বসেছে।