পাতা:ছিন্নপত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

লণ্ডন,

১০ই অক্টোবর, ১৮৯০।

 মানুষ কি লোহার কল, যে, ঠিক নিয়ম-অনুসারে চলবে? মানুষের মনের এত বিচিত্র এবং বিস্তৃত কাণ্ড কারখানা, তার এত দিকে গতি এবং এত রকমের অধিকার যে এদিকে ওদিকে হেলতেই হবে। সেই তার জীবনের লক্ষণ, তার মনুষ্যত্বের চিত্ন, তার জড়ত্বের প্রতিবাদ। এই দ্বিধা, এই দুর্ব্বলতা যার নেই তার মন নিতান্ত সঙ্কীর্ণ এবং কঠিন এবং জীবনবিহীন। যাকে আমরা প্রবৃত্তি বলি এবং যার প্রতি আমরা সর্ব্বদাই কটুভাষা প্রয়োগ করি সেই ত আমাদের জীবনের গতিশক্তি—সেই আমাদের নানা সুখদুঃখ পাপপুণ্যের মধ্যে দিয়ে অনন্তের দিকে বিকশিত করে তুল্‌চে। নদী যদি প্রতি পদে বলে, কই সমুদ্র কোথায়—এ যে মরুভূমি—ঐ যে অরণ্য—ঐ যে বালির চড়া—আমাকে যে শক্তি ঠেলে নিয়ে যাচ্চে সে বুঝি আমাকে ভুলিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্চে—তা হলে তার যেরকম ভ্রম হয় প্রবৃত্তির উপরে একান্ত অবিশ্বাস করলে আমাদেরও কতকটা সেই রকম ভ্রম হয়। আমরাও প্রতিদিন বিচিত্র সংশয়ের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যাচ্চি—আমাদের শেষ আমরা দেখ্‌তে পাচ্চি নে—কিন্তু যিনি আমাদের অনন্ত জীবনের মধ্যে প্রবৃত্তি নামক প্রচণ্ড গতিশক্তি দিয়েচেন তিনিই জানেন তার দ্বারা আমাদের কিরকম করে চালনা করবেন। আমাদের সর্ব্বদা এই একটা মস্ত ভুল হয় যে আমাদের প্রবৃত্তি আমাদের যেখানে নিয়ে এসেচে সেইখানেই বুঝি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে—আমরা তখন জান্‌তে পারিনে সে আমাদের তার মধ্যে থেকে টেনে তুল্‌বে। নদীকে যে শক্তি মরুভূমির মধ্যে নিয়ে আসে সেই শক্তিই সমুদ্রের মধ্যে নিয়ে যায়। ভ্রমের মধ্যে যে ফেলে ভ্রম থেকে সেই টেনে নিয়ে যায়—এই রকম করেই আমরা চলচি। যার এই প্রবৃত্তি অর্থাৎ জীবনীশক্তির প্রাবল্য নেই, যার মনের রহস্যময় বিচিত্র বিকাশ নেই, সে সুখী হতে পারে সাধু হতে পারে, এবং তার সেই সঙ্কীর্ণতাকে লোকে মনের জোর বল্‌তে পারে—কিন্তু অনন্ত জীবনের পাথেয় তার বেশী নেই।