পাতা:ছিন্নমুকুল - স্বর্ণকুমারী দেবী.pdf/১০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০৪
ছিন্নমুকুল

কনককে মারিয়া ফেলিলে, তোমার কঠোরতাতেই তাহার জীবন বিনষ্ট হইল।” সুশীলা তখন সে দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া “কনক, কনক” করিয়া ছুটিয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, কনক শয্যায় উপবিষ্ট। তাহাকে জীবিত দেখিয়া তিনি যেন পুনরায় জীবন প্রাপ্ত হইলেন, সকল দোষ ভুলিয়া গিয়া সহর্ষে বালিকার মুখচুম্বন করিলেন। এই সময় আবার গীতধ্বন উথলিয়া তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল—

“বুঝি গো সে এলনা”—

 গানটী শুনিবার জন্য সুশীল কাণ পাতিলেন, কিন্তু গান এইখানেই থামিয়া গেল। কে গান গাহিতেছে দেখিবার জন্য তিনি বাতায়নে দাঁড়াইলেন, কিছুই দেখিতে পাইলেন না, কেবল সম্মুখস্থ জাহ্নবী-নদীর তরঙ্গ উচ্ছাস সে অন্ধকারের মধ্যেও তাঁহার চক্ষে প্রতিভাত হইল। তীরে মনুষ্যের চিহ্নও দেখিতে পাইলেন না, কিন্তু মনে হইল প্রাচীরের নিকট হইতে গীত-ধ্বনি উঠিতেছিল। থাকিয়া থাকিয়া আবার কে গাহিয়া উঠিল—

“চির দিন চির নিশি, জাগরণে গেছে মিশি
তাহারি বিরহ মাঝে ধরিয়া আশার কণা”!

 গান শুনিয়া সুশীলর মাথা ঘুরিয়া আসিল, তাঁহার কত কথাই মনে পড়িতে লাগিল, সেই বালিকাজীবন, বাল্যের সুখ দুঃখ সমস্তই মনে উদয় হইল। সুশীলা আশ্চর্য্য হইয়া নিস্পন্দে আবার সেই গানটির শেষ পর্য্যন্ত শুনিবার জন্য অপেক্ষা করিয়া রহিলেন। কেহই আর গাহিল না,—কিন্তু সেই প্রাচীরের অভিমুখে একজন লোককে তিনি আসিতে দেখিলেন। ক্রমে সে নিকটে আগমন করিল। এই সময় বিদ্যুতালোকে সেই ব্যক্তি তাঁহাকে দেখিতে পাইল, সুশীলাও তাহাকে দেখিতে পাইলেন, তাঁহাদের পরস্পর নয়নে নয়নে সংলগ্ন হইল, অমনি সুশীলা মূর্চ্ছিত হইয়া বাত্যাহত বৃক্ষের ন্যায় ভূমিশায়িত হইলেন।