পাতা:ছিন্নমুকুল - স্বর্ণকুমারী দেবী.pdf/১২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ
১২১

জ্বলন্ত বহ্নি যখন সুশীলাকে আপনার মধ্যে লুকাইয়া ফেলিলেন তখন দয়ানন্দের বিদীর্ণহৃদয় হইতে একবার ধ্বনিত হইল—ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ হরিঃ ওঁ—” তাহার পর নভোমণ্ডলস্খলিত নক্ষত্রের ন্যায় দ্রুতপদে তিনি পশ্চাৎমুখী হইয়া চলিয়া গেলেন, একবার ফিরিয়াও চাহিলেন না।

 কনক শববাহিদলের সঙ্গে সঙ্গে আসিয়া অশ্রুহীন সুকরুণ প্রস্তর মূর্ত্তিবৎ চিতার নিকটেই দাঁড়াইয়া ছিল। অগ্নি সংযোগের পূর্ব্বে নয়ন প্রাণ ভরিয়া শেষবার সে স্নেহময়ী জননীতুল্যা মাতৃশ্বসার প্রশান্ত মূর্ত্তি এক দৃষ্টে চাহিয়া দেখিতেছিল। যখন সর্ব্বগ্রাসী অগ্নি তাহাকে গ্রাস করিতে আরম্ভ করিল—কনক আর দেখিতে পারিল না, এতক্ষণ কষ্টে তাহার অশ্রুরাশি স্তম্ভিত হইয়া পড়িয়াছিল সহসা উন্মত্তের মত চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিয়া সেখান হইতে সে চলিয়া গেল। একজন দাসী কনককে গৃহভিমুখে যাইতে দেখিয়া নিকটে আসিয়া বলিল “এখন এ কাপড়ে ঘরে যেতে নেই। গঙ্গা নেয়ে চল পরে ঘরে যাবে।” দাসীর কথায় কনক নিস্তদ্ধে তাহার সঙ্গে সঙ্গে নদীতীরে আগমন করিল।

 রজনী স্তব্ধ গম্ভীর ও অন্ধকার। সেই তমসাচ্ছন্ন নিশীথে গঙ্গার অতল জলরাশির উপর দুইটি স্ত্রীলোক আসিয়া নামিল। অন্ধকারে আর কিছুই দেখা যায় না, কেবল উর্দ্ধে আকাশ নীচে চরণতলে জলরাশি, তল তল, ঢল ঢল করিয়া উদাসগীতি গাহিয়া সকল্লোলে, বহিয়া চলিতেছে, আর উপরে তারকাখচিত স্তব্ধ আকাশ দিগন্ত সীমাবদ্ধ করিয়াও অসীমরূপে প্রসারিত হইয়া আছে। নদীগর্ভে জলের উপরও যত্রতত্র আকাশ ভাসিয়া বেড়াইতেছে, তারকারাশি হাসির ছটা বিকীর্ণ করিয়া দূরের অন্ধকার আরো ঘনীভুত করিতেছে। আকাশলোক ছাড়া গঙ্গা বক্ষঃস্থিত একখানি নৌকার প্রদীপ মিট মিট করিয়া এক একবার আলেয়ার ন্যায় প্রকাশ পাইতেছিল। কনক সেই আলোকটির পানে চাহিয়া চাহিয়া জলে নামিল। দেখিতে