পাতা:ছিন্নমুকুল - স্বর্ণকুমারী দেবী.pdf/৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
প্রথম পরিচ্ছেদ

কিছু দূরে হিরণকুমার দাঁড়াইয়া তাহাদের খেলা দেখিতেছেন। হিরণকুমার অষ্টাদশবর্ষীয়, তাঁহার বর্ণ উজ্জ্বলশ্যাম, চক্ষু সুদীর্ঘ, দৃষ্টি শাস্ত অথচ জ্যোতির্ম্ময়। যৌবনের প্রাক্কালে যে সকল মনের গুণ স্ফূর্ত্তি পাইয়া মানুষের বাহ্য আকৃতিকেও স্ফূতির্ময় করিয়া তোলে, সেই সকল গুণের প্রাচুর্য্যবশতঃ যেন হিরণকুমারের মুখে এবং সমস্ত শরীরে একটি অলৌকিক তেজের প্রভাব প্রকাশ পাইতেছিল। হিরণকুমার দেখিলেন, বালকটি কখনও উদ্যানে কোদাল লইয়া মাটি কাটিতেছে, কখনও দৌড়িয়া গাছের কোন শুষ্ক শাখা ভাঙ্গিতেছে, কখনও বা কোন জলপাত্র হস্তে লইয়া ফুলগাছের গোড়ায় জল ঢালিতেছে। বালকটি দশমবর্ষীয়, শরীর সুগোল সুঠাম হৃষ্টপুষ্ট, মুখাবয়ব সুন্দর, কৃষ্ণ ভ্রযুগলের নীচে চঞ্চল চক্ষুদ্বয় যেন জ্বলিতেছে, কুঞ্চিত কেশরাশি উন্নত ললাট বেষ্টন করিয়া তাহার সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করিতেছে। মুখশ্রী দেখিলে বালকটিকে সরল উদারচেতা, এবং কিছু উদ্ধতস্বভাব বলিয়া বোধ হয়।

 বালিকাটি কিছু কৃশ, ক্ষুদ্র মস্তকে নিবিড় কেশজাল,—তাহা স্কন্ধদেশের নিম্নভাগ পর্য্যন্ত আবরিত করিয়াছে; মধ্যে মধ্যে সেই স্থানচ্যুত ভ্রমরকৃষ্ণ কেশরাশি বৃক্ষে কপোলে পড়িয়া তাহার গোলাপকলিকা সদৃশ মুখখানির মধুরতা বৃদ্ধি করিতেছে। তাহার সেই সুদীর্ঘ কেশর-ঘন চক্ষু দুইটির দৃষ্টি শান্ত ও করুণ; দৃষ্টিতে যেন কেমন সঙ্কুচিত, কেমন শশঙ্কিত ভাব; নেত্রপল্লব যেন কিসের ভারে সর্ব্বদাই ভারাক্রান্ত, তাহাদের যেন সেই দীর্ঘায়তন চক্ষুর সমস্ত আয়তন বিকাশ করিবার সামর্থ্যই নাই। মুখখানি শৈশবের চঞ্চলতাপূর্ণ প্রফুল্লভাবে স্ফূর্ত্তিযুক্ত নহে। তাহা কেমন যেন ঈষৎ বিষণ্নভাবে আবরিত, পূর্ণিমার জ্বলন্ত উজ্জ্বলতার উপর যেন মেঘের ছায়া পড়িয়া সমস্ত মুর্ত্তিতে একটি ভয়ের ভাব, একটি বিষণ্ন ভাব, একটি করুণ ভাব আঁকিয়া দিয়াছে।