পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০২
জননী

দোকান চলিবে ভরসা হইল না। শ্যামা-ষ্টোরসএর সামনে রাস্তার ওপারে মস্ত মনোহারি দোকান, চারপাঁচটা বিদ্যুতের আলো, টিমটিমে কেরাসিনের আলো জ্বালা মামার অতটুকু দোকানে কে জিনিস কিনিতে আসিবে? মামার যেমন কাণ্ড, দোকান দিবার আর যায়গা পাইল না।

 মামার উৎসাহের অন্ত নাই, বিধান ও খুকী দোকান দোকান করিয়া পাগল, মণিরও দুবেলা দোকানে যাওয়া চাই। মামা ওদের বিস্কুট ও লজেঞ্জুষ দেয়, দোকানের আকর্ষণ ওদের কাছে তাহাতে আরও বাড়িয়া গিয়াছে। জিনিস বিক্রয় করিবার সখ বিধানের প্রচণ্ড। বলে, এবার যে খদ্দের আসবে তাকে আমি জিনিস দেব দাদু, এ্যাঁ? মামা বলে, পারবি কি খোকা, খদ্দের বিগড়ে দিবি শেষে! কিন্তু অনুমতি মামা দেয়। বিধান ছোট শো-কেসটির পিছনে টুলটার উপরে গম্ভীর মুখে বসে, মামা কোণের বেঞ্চিটার উপর বসিয়া চশমা চোখে দিয়া বিড়ি টানিতে টানিতে খবরের কাগজ পড়ে। ক্রেতা যে আসে হয়ত সে পাড়ার ছেলে, ঈর্ষার দৃষ্টিতে বিধানের দিকে চাহিয়া বলে, কি রে বিধু!—বিধান বলে, কি চাই? সে পাকা দোকানী, কেনা বেচার সময় তার সঙ্গে বন্ধুত্ব অচল, খোস গল্প করিবার তার সময় কই? চশমার ফাঁক দিয়া মামা সহকারীর কার্যকলাপ চাহিয়া দ্যাখে, বলে, কালি? ওই ও কোণার টিনের কৌটোতে—দু’বড়ি এক পয়সায়, কাগজে মুড়ে দে বোকা!

 এদিকে দোকান চলে, ওদিকে মামা আজ দশটাকা কাল পাঁচটাকা সংসার খরচ আনিয়া দেয়: মামার চারিদিকে রহস্যের ভাঙ্গা আবরণটি আবার যেন গড়িয়া উঠিতে থাকে। পাড়ার লোকে এতকাল মামাকে অতিথি বলিয়া খাতির করিত, এখন প্রতিবেশী গৃহস্থের প্রাপ্য সহজ সমাদর দেয়, তবে অতটুকু দোকান দেওয়ার জন্য পাড়ার অনেক চাকুরে বাবুর কাছে মামার আসন নামিয়া গিয়াছে, খুব যারা বাবু দু’এক পয়সার জিনিস কিনিতে মামাকে তাদের কেহ তুমি পর্যন্ত বলিয়া বসে।

 মামা বলে, কি চাই বললে? পরিমল নস্যি? ওই ও দোকানে যাও!

 অপমান করিয়া মামার কাছে কারো পার পাওয়ার যো নাই।