পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
১১৭

হাসিয়া লুটাইয়া পড়িত, কনকের স্বামী যখন তাহাকে শূন্যে তুলিয়া চৌবাচ্চায় একটা চুবানি দিয়া আবার বুকে করিয়া ঘরে লইয়া যাইত, খানিক পরে শুকনো কাপড় পরিয়া আসিয়া কনকের কাজের ছন্দে আবার অকাজের ছন্দ মিশিতে থাকিত তখন শ্যামার—কে জানে কি হইত শ্যামার চোখের জল গাল বাহিয়া তাহার মুখের হাসিতে গড়াইয়া আসিত।

 কনকের স্বামী আপিস গেলে সে নীচে নামিয়া বলিত, সব দেখে ফেলেছি কনক।

 কনকের লজ্জা নাই। সে হাসিয়া ফেলিত। জ্বালিয়ে মারে দিদি, আপিস গেলে যেন বাঁচি।

 দোতালার ঘরখানা আর ছাদটুকু ছিল শ্যামার গৃহ। জিনিসপত্র সহ সে বাস করিত ঘরে বাঁধিত ছাদে একখানা করোগেটেড টিনের নীচে। পাশে শুধু নকুড়বাবুর ছাদ নয়, আশে পাশের আরও কয়েক বাড়ির ছাদ হইতে উদয়াস্ত শ্যামার সংসারের গতিবিধি দেখা যাইত। প্রথম প্রথম অনেকগুলি কৌতূহলী চোখ দেখিতেও ছাড়িত না। যখন তখন ছাদে উঠিয়া নকুড়বাবুর বৌ জিজ্ঞাসা করিত, কি করছ বকুলের মা? শ্যামা বলিত, রাঁধছি দিদি—বলিত সংসারের কাজকর্ম করছি দিদি—কি রাঁধলেন এবেলা? রাঁধিত এবং সংসারের কাজকর্ম করিত শ্যামা, আর কিছু করিত না? ধানকলের ধূমোদ্গারী চোঙটার দিকে চাহিয়া থাকিত না? রাত্রে ছেলেমেয়েরা ঘুমাইয়া পড়িলে জাগিয়া বসিয়া থাকিত না? হিসাব করিত না দিন মাস সপ্তাহের টাকা আনা পয়সার?

 উদভ্রান্ত চিন্তাও শ্যামা করিত, নিশ্বাসও ফেলিত। জননীত্ব কেমন যেন নীরস অর্থহীন মনে হইত শ্যামার কাছে। কোথায় ছিল এই চারটি জীব, কি সম্পর্ক ওদের সঙ্গে তাহার? অসহায়া স্ত্রীলোক সে, মেরুদণ্ড বাঁকানো এ ভার তার ঘাড়ে চাপিয়া বসিয়াছে কেন? কিসের এই অন্ধ মায়া? জগজ্জননী মহামায়া কিসের ধাঁধাঁয় ফেলিয়া তাহাকে দিয়া এত দুঃখ বরণ করাইতেছেন? সুখ কাকে বলে, একদিনের জন্য সে তাহা জানিতে পারিল না। তাহার একটা প্রাণ নিঙড়াইয়া চারটি প্রাণীকে সে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে—কেন? কি লাভ তাহার? চোখ বুজিয়া সে যদি আজ কোথাও চলিয়া যাইতে পারিত!—ওরা