পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৩৬
জননী

না! শুনিয়া হারান খুসি হয়। বলে, দাও দিকি কাগজ কলম, ওষুদ লিখি। আর মন দিয়ে শোনো যা যা বলে যাই, এতটুকু এদিক ওদিক হলে চলবে না,—টুকেই নাও না কথাগুলো আমার? মনে যা থাকবে আমার জানা আছে।

 একে একে হারান বলিয়া যায়,—ওষুদ, পথ্য, সেবার নির্দেশ। ঘড়ির কাঁটা ধরিয়া সময় বাঁধিয়া দেয়। বারবার সাবধান করে, এতটুকু এদিক ওদিক নয়, আটটায় যে ওষুদ দেওয়ার কথা দিতে যেন আটটা বাজিয়া পাঁচ মিনিটও না হয়, যখন দু’চামচ ফুড দেওয়ার কথা তিন চামচ যেন তখন না পড়ে।

 শ্যামা ভয়ে ভয়ে বলে, কোন ব্যবস্থাই তো নেই এখেনে, খালি বাড়িতে এসে উঠেছি আমরা, বনগাঁ কি নিয়ে যাওয়া যাবে না?

 হারান যেন আনমনেই বলে, বনগাঁ? তা চল, বনগাঁতেই নিয়ে যাই,—একটা দিন আমার নষ্ট হবে, হলে আর উপায় কি? জ্বর করে, না খেয়ে, ঠাণ্ডা লাগিয়ে কি কাণ্ডই বাধিয়ে রেখেছে হতভাগা! ক’টায় গাড়ি? দেড়টায়? তবে সময় আছে ঢের, যাও দিকি তুমি রাখাল ওষুদপত্রগুলি নিয়ে এসো কিনে, আমি ক’টা রোগী দেখে আসছি ঘুরে এগারোটার মধ্যে।—দু’টো পান আমায় দিতে পার ছেঁচে? দোক্তা থাকে তো দিও খানিকটা।

 হারান বুড়া হইয়া গিয়াছে, পান চিবাইতে পারে না, ছেঁচা পান খায়। কিন্তু হারান বদলায় নাই। বুড়া হইতে হইতে সে মরিয়া যাইবে, তবু বোধ হয় বদলাইবে না। শ্যামা কি জানে না আত্মীয়তা করিয়া শীতলকে সে বনগাঁ পৌঁছাইয়া দিতে যাইতেছে না, যাইতেছে ডাক্তার হইয়া রোগীর সঙ্গে? শ্যামার বলার অপেক্ষা রাখে নাই। তা সে কোন দিনই রাখে না। সেই প্রথমবার বিধানের অসুখের সময় জরতপ্ত শিশুটিকে সে যে গামলার ঠাণ্ডা জলে ডুবাইয়াছিল সেদিনও সে শ্যামার বলার অপেক্ষা রাখে নাই। যা করা উচিত হারান তাই করে। হারানের স্নেহ নাই, আত্মীয়তা নাই, কোমলতা নাই, কতবার ভুল করিয়া শ্যামা ভাবিয়াছে হারান তাহাকে মেয়ের মত ভালবাসে! তাই যদি সে বাসিবে, তবে বাড়িভাড়ার নাম করিয়া টাকা শ্যামাকে সে পাঠাইবে কেন? সোজাসুজি পাঠাইতে কে তাকে বারণ করিয়াছিল? পরের দান গ্রহণ করিতে অন্য সকলের কাছে শ্যামা লজ্জা পাইবে, এই জন্য? হারানের মধ্যে ওসব দুর্বলতা নাই। কে কোথায় কি কারণে লজ্জা পাইবে