পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪০
জননী

 তবু ছেলের পড়া চালানোর জন্য বাড়িটা শ্যামার হয়ত বিক্রয় করিতে হইত না, যদি বাঁচিয়া থাকিত হারান ডাক্তার। বিধানকে হারানের বাড়ি পাঠাইয়া সে লিখিত, বাবা, জীবনপাত করে ওর স্কুলের পড়া সাঙ্গ করেছি, আর তো আমার সাধ্য নেই, এবার দিন বাবা, ওর আপনি কলেজে পড়ার একটা ব্যবস্থা করে। হারান তা দিত। শ্যামার সন্দেহ ছিল না। কিন্তু হারানের অনেক বয়স হইয়াছিল, বিধানের স্কুলের পড়া শেষ হওয়া পর্যন্ত সে বাঁচিয়া থাকিতে পারিল কৈ?

 হারান মরিয়াছে। মরিবে না? কপাল যে শ্যামার মন্দ। হারান বাঁচিয়া থাকিলে শ্যামার ভাবনা কি ছিল? বাড়িতে শ্যামার ভাড়াটে আসিয়াছিল, তারা কুড়ি টাকা পাঠাইত শ্যামাকে আর হারান পাঠাইত পঁচিশ। হারানের মনি অর্ডারের কুপনে কোন অজুহাতের কথা লেখা থাকিত না, শুধু অপাঠ্য হাতের লেখায় স্বাক্ষর থাকিত হারানচন্দ্র দে। শ্যামা তো তখন ছিল বড়লোক। কয়েক মাসে শ’ দেড়েক টাকাও সে জমাইয়া ফেলিয়াছিল। কেন মরিল হারান? কত মানুষ সত্তর আশি বছর বাঁচিয়া থাকে। পঁয়ষট্টি পার হইতে না হইতে হারানের মরিবার কি হইয়াছিল?

 শ্যামা কি করিবে? ভগবান যার প্রতি এমন বিরূপ বাড়ি বিক্রি করিয়া না দিয়া তার উপায় কি।

 শহরতলীর বাড়ি, তাও বড় রাস্তার উপরে নয়, দক্ষিণ খোলা নয়। একতলাটা পুরানো। বাড়ি বেচিয়া শ্যামা হাজার পাঁচেক টাকা পাইয়াছিল।

 টাকা থাকিলে খরচ কেন বাড়িয়া যায় কে জানে। আগে ছোট-বড় অনেক খরচ মন্দার উপর দিয়া চালানো যাইত, কিন্তু পুঁজি যার পাঁচ হাজার টাকা সে কেন তা পারিবে? মন্দাই বা দিবে কেন? দুধের কথাটা ধরা যাক। দুধ অবশ্য কেনা হয় না, বাড়িতে পাঁচ ছ'টা গরু আছে। কিন্তু গরুর পিছনে খরচ তো আছে? শ্যামার ছেলেমেয়েরা দুধ তো খায়? শ্যামা পাঁচ হাজার টাকা পাওয়ার মাসখানেক পরে মন্দা বলে, পয়সা কড়ি হাতে নেই বৌ, এ-মাসের খোল কুঁড়োর দামটা দিয়ে দাও না,—সামনের মাসে আনাব'খন আমি।

 কুঁড়ো কেনা হইবে কেন? সেদিন যে দু’মণ চাল করা হইল তার কুঁড়ো