পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
১৭৭

 মণি কাতর কণ্ঠে বলে, আর একটু ঘুমোই মা, কত রাত পর্যন্ত পড়েছি জানো?

 জানে না! শ্যামা জানে না তার ছেলে কত রাত অবধি পড়িয়াছে! দোতলা একতলার ব্যবধান কি ফাঁকি দিতে পারে শ্যামাকে! কতবার উঠিয়া আসিয়া সে উঁকি দিয়া গিয়াছে মণি তার কি জানে!

 একটু চা বরঞ্চ তোকে করে দি চুপি চুপি, খেয়ে চাঙ্গা হয়ে পড়তে সুরু কর। পড়ে শুনে মানুষ হয়ে কত ঘুমোবি তখন—ঘুম কি পালিয়ে যাবে!

 কনকনে হাড় কাঁপানো শীত, বকুলকে সঙ্গে করিয়া শীতল যেবার পালাইয়া গিয়াছিল সেবার ছাড়া শীত শ্যামাকে কোনবার এমন কাবু করিতে পারে নাই। উনানে আঁচ দিয়া ডালের হাঁড়িটা মাজিতে বসিয়া হাত পা শ্যামার যেন অবশ হইয়া আসে। কি হইয়াছে দেহটার? এই ভাল থাকে এই আবার খারাপ হইয়া যায়? মাঝে মাঝে এক একদিন তো শীত লাগে না, ঝরঝরে হাল্কা মনে হয় শরীরটা, আবছা ভোরে ঘুমন্ত-পুরীতে মনের আনন্দে কাজে হাত দেয়? কোনদিন মনে হয় বয়সটা আজো পঁচিশের কোঠায় আছে, কোনদিন মনে হয় একশো বছরের সে বুড়ী! এমন অদ্ভুত অবস্থা হইল কেন তাহার?

 রোদের সঙ্গে বিধান ওঠে। এখনি সে ছেলে পড়াইতে বাহির হইয়া যাইবে কিন্তু তাহার হৈ চৈ হাঁক ডাক নাই। নিঃশব্দে মুখ হাত ধুইয়া জামা গায়ে দেয়, নীরবে গিয়া রান্না ঘরে বসে, শ্যামা যদি বলে, ডালটা হয়ে এল, নামিয়ে রুটি সেঁকে দি?—সে বলে, না দেরি হইয়া যাইবে, আগে রুটি চাই। দুটো একটা কথা সে বলে, বেশির ভাগ সময় চুপ করিয়া ভোরবেলাই শ্যামার শ্রান্ত মুখখানার দিকে চাহিয়া থাকে। সে বুঝিতে পারে শ্যামার শরীর ভাল নয়, ভোরে উঠিয়া সংসারের কাজ করিতে শ্যামার কষ্ট হয়, কিন্তু কিছুই সে বলে না। মুখের কথায় যার প্রতিকার নাই সে বিষয়ে কথা বলিতে বিধানের ভাল লাগে না। ভোরে উঠিতে বারণ করিলে শ্যামা কি শুনিবে?

 বিধান চলিয়া গেলে খানিক পরে শ্যামা দোতালায় যায়, এতক্ষণে ছাদে রোদ আসিয়াছে। জানালা খুলিয়া দিতে শীতলের গায়ে রোদ আসিয়া পড়ে। শীতল ক্ষীণকণ্ঠে বলে, কটা বাজল গা?

 ১২