পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দুই

দু বছরের মধ্যে শ্যামার কোলে আবার ছেলে আসিল। সেই বাড়িতে সেই ছােট ঘরে শরৎকালের তেমনি এক গভীর নিশীথে। কিন্তু মানুষের জীবনে অভাবের পূরণ আছে, ক্ষতির পূরণ নাই বলিয়া প্রথম সন্তানকে শ্যামা ভুলিতে পারে নাই। ছেলে মরিয়া যাওয়ার পর কয়েকমাস সে মুহ্যমানা হইয়াছিল, এই অবস্থাটি অতিক্রম করিতে তাহার মধ্যে যে পবিবর্তন আসিয়াছিল এখনাে তাহা স্থায়ী হইয়া আছে। সন্তানের আবির্ভাবে এবার আর তাহার সেই অসংযত উল্লাস আসে নাই, উদ্দাম কল্পনা জাগে নাই। সে শান্ত হইয়া গিয়াছে। সংসারধর্ম করিলে ছেলেমেয়ে হয়, ছেলেমেয়ে হইলে মানুষ সুখী হয় এবারের ছেলে হওয়াটা তাহার কাছে শুধু এই। এতে না আছে বিস্ময়, না আছে উন্মত্ততা—চোখে পলকে একটা বিরাট ভবিষ্যতকে গড়িয়া তুলিয়া বহিয়া বেড়ানাে, ক্ষণে ক্ষণে নব নব কল্পনার তুলি দিয়া এই ভবিষ্যতের গায়ে রঙ মাখানাে আব সর্বদা ভয়ে ও আনন্দে মশগুল হইয়া থাকা, এসবই কিছুই নাই। এবারও আঁতুড়ে এগারোটি দিবারাত্রি অনির্বাণ দীপ জ্বলিয়াছিল, কিন্তু শ্যামার এবার একেবারেই ভয় ছিল না। শুধু ছিল গভীর বিষণ্ণতা। এবার পূর্বপুরুষেরা গভীর রাত্রে শ্যামার ছেলেকে ভিড় করিয়া দেখিতে আসেন নাই। ছেলের ক্ষীণ বক্ষম্পন্দন হঠাৎ একসময় থামিয়া যাইতে পারে শ্যামার এ আশঙ্কা ছিল, কিন্তু আশঙ্কায় ব্যাকুল হইয়া সে জাগিয়া রাত কাটায় নাই। এ বিষয়ে তাহার কেমন একটা উদাসীনতা আসিয়াছে। ভাবিয়া লাভ নাই, উতলা হইযা লাভ নাই, ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা করিয়া কোন ফল হইবে না। যিনি দেন তিনিই নেন। তাঁর দেওয়াকে যখন ঠেকানাে যায় না নেওয়াকে ঠেকাইবে কে?

 সে শীতলকে স্পষ্ট বলিয়াছে: এবাব আব যত্নটত্ন করব না বাবু।

 অযত্ন করা কি ভাল হবে?

 অযত্ন করব না তাে। নাওয়াবাে খাওয়াবাে যেমন যেমন দরকাব সব করব। তার বেশি কিছু নয়। কি হবে করে?