পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/১৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
১৮১

গিয়াছিল কেন? কত বড় সংসার গড়িয়া উঠিবে তাহার। এখনি হইয়াছে কি! বিধানের বৌ আসিবে, মণির বৌ আসিবে, ফণীর বৌ আসিবে,—যে ঘরে ওদের সে প্রসব করিয়াছিল সেই ঘরে এক একটি শুভদিনে আসিতে থাকিবে নাতিনাতনির দল। দোতালায় সে আরও ঘর তুলিবে, পিছন দিকের উঠানে দালান তুলিয়া আরও বড় করিবে বাড়ি। অত বড় বাড়ি তাহার ভরিয়া যাইবে নবীন নরনারীতে—ও-বাড়ির নকুড় বাবুর শাশুড়ির মত মাথায় শনের নুড়ি ঝুলাইয়া কুঁজো হইয়া সে দাঁড়াইয়া থাকিবে জীবনের সেই বিচিত্র উজ্জ্বল আবর্তের মাঝখানে!

 সবই তো এখনো তাহার বাকি?

 কেবল একটা দুঃখ তাহাকে আজীবন দহন করিবে। তার অন্ধ মেয়েটা। ওর জন্য অনেক চোখের জল ফেলিতে হইবে তাহাকে।

 শ্যামা মেয়ে খুঁজিতে লাগিল। সুন্দরী, সদ্বংশজাতা, স্বাস্থ্যবতী, গৃহকর্মনিপুণা, কিছু কিছু গানবাজনা লেখাপড়া সেলাইএর কাজ জানা, চোদ্দ পনর বছর বয়সের একটি মেয়ে। খানিকটা শামুর মত, খানিকটা শ্যামার ভাড়াটে সেই কনকের মত আর খানিকটা শ্যামার কল্পনার মত হইলেই ভাল হয়। টাকা শ্যামা বেশি চায় না, অসম্ভব দাবী তার নাই।

 কয়েকটি মেয়ে দেখা হইল, পছন্দ হইল না। তারপর পাড়ার একবাড়ির গৃহিণী, শ্যামার সঙ্গে তার মোটামুটি আলাপ ছিল, একটি খুব ভাল মেয়ের সন্ধান দিলেন। শহরের অপরপ্রান্তে গিয়া মেয়েটিকে দেখিবামাত্র শ্যামা পছন্দ করিয়া ফেলিল। বড় সুন্দরী মেয়েটি, যেমন রঙ তেমনি নিখুঁত মুখ চোখ। আর কোমল আর ক্ষীণ আর ভীরু। শ্যামাকে যখন সে প্রণাম করিল মনে হইল দেহের ভার তুলিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইতে পারিবে না, এমন নরম সে মেয়ে, এত তার কোমলতা।

 মেয়ে পছন্দ করিয়া শ্যামা বাড়ি ফিরিল। সে বড় খুসি হইয়াছে। এমন মেয়ে যে খুঁজিলেও মেলে না! কি রূপ, কি নম্রতা! ওর কাছে কোথায় লাগে শামু?

 মোহিনীর সঙ্গে বিধানকে সে একদিন জোর করিয়া মেয়ে দেখিতে পাঠাইয়া দিল। ফিরিয়া আসিয়া মোহিনী বলিল, না মা, পছন্দ হল না মেয়ে।