পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
৪১

তাহার মৃত্যুযন্ত্রণা দেখিতেছিল। দেখিয়া শ্যামা সেদিন ভয়ানক রাগিয়া গেল। রাণীকে ছাড়িযা দিয়া ছেলেকে সে বেদম মার মারিল। বিধানের স্বভাব কিন্তু বদলাইল না। পিঁপড়ে দেখিলে সে টিপিয়া মারে, ফড়িঙ ধরিয়া পাখা ছিঁড়িয়া দেয়, বিড়ালছানা কুকুরছানা পুষিয়া হঠাৎ একদিন যন্ত্রণা দিয়া মারিযা ফেলে। বারো তেরো বছর বয়স হওয়ার আগে তাহার এ স্বভাব শোধরায় নাই।

 এখন শীতলেব আয় কিছু বাড়িয়াছে। পিতার আমল হইতে তাহাদের নিজেদের প্রেস ছিল। প্রেসের কাজ সে ভাল বােঝে। তার তত্ত্বাবধানে কমল প্রেসের অনেক উন্নতি হইয়াছে। প্রেসের সমস্ত ভার এখন তাহার। মাহিনার উপর সে লাভের কমিশন পায়, উপরি আয়ও কিছু কিছু হয়। সেটা এই রকম। ব্যবসায়ে অনেক কিছুই চলে। অনেক কোম্পানীর যে কর্মচারীর উপর ছাপার কাজের ভার থাকে, ফর্মা পিছু আট টাকা দিয়া সে প্রেসের দশ টাকার বিল দাবী করে এরকম বিল দিতে হয়। প্রেসের মালিক কমল ঘােষ তাহা জানে। তাই খাতাপত্রে দশ টাকা পাওনা লেখা থাকিলেও আট অথবা দশ কত টাকা ঘরে আসিয়াছে, সব সময় জানিবার উপায় থাকে না। জানে শুধু সে প্রেসের ভার থাকে যাহার উপব। শীতল অনায়াসে অনেক দশ টাকা পাওনাকে আট টাকা দাঁড় করাইয়া দেয়। প্রেসের মালিক কমল ঘােষ হয়ত মাঝে মাঝে সন্দেহ করে কিন্তু প্রেসের ক্রমােন্নতি দেখিয়া কিছু বলে না।

 শীতলের খুব পরিবর্তন হইয়াছে। কমল প্রেসে চাকরী পাওযার আগে সে দেড় বছর বেকার বসিয়াছিল। যেমন হয়, এই দুঃখের সময় সুসময়ের বন্ধুদের চিনিতে তাহার বাকি থাকে নাই। এবার তাদের সে আর আমল দেয় না। সােজাসুজি ওদের ত্যাগ করিবার সাহস তাে তার নাই, এখন সে ওদের কাছে দারিদ্র‍্যের ভান করে। দেড় বছর গরীব হইয়া থাকিবার পর এটা সে সহজেই করিতে পারে। তার মধ্যে ভারি একটা অস্থিরতা আসিয়াছে। কিছুদিন খুব স্ফূর্তি করিয়া কাটানাের পর শ্রান্ত মানুষের যে রকম আসে, কিছু ভাল লাগে না, কি করিবে ঠিক পায় না। শ্যামার সঙ্গে গােড়া হইতে মনের মিল করিয়া রাখিলে এখন সে বাড়িতেই একটি সুখ দুঃখের সঙ্গী পাইত,