পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
৪৫

ননদদের সে হয়ত আর গ্রাহ্য করে না। রাখালের উপর তাহার অসীম প্রতিপত্তি দেখা গেল। কথা তাে বলে না যেন হুকুম দেয়, আর যা সে বলে তাই রাখাল শােনে।

 সতীন—হ্যাঁ, সে এখানেই থাকে বৌ, বড্ড গরীবের মেয়ে, বাপের নেই চালচুলাে, এখানে না থেকে আর কোথায় যাবে বল, যাবার যায়গা থাকলে তাে যাবে—বাপ ব্যাটা ডেকেও জিগ্যেস করে না। চামারের হদ্দ সে মানুষটা, ওই করে তাে মেয়ে গছালে। ছল করে বাড়ি ডেকে নিয়ে যেত, আজ নেমন্তন্ন, কাল মেয়ের অসুখ—মন্দা হাসিল। পাড়ার মেয়ে ভাই ছুড়িকে এইটুকু দেখেছি, হ্যাংলার মত ঠিক খাবার সময়টিতে লােকের বাড়ি গিয়ে হাজিব হত। কে জানত বাবা ও শেষে বড় হয়ে আমারি ঘাড় ভাঙ্গবে।

 মন্দার মেয়ে দু'টিকে শ্যামা খুব আদর করিল আর শ্যামার ছেলেকে আদর করিল মন্দা। রেষারেষি করিয়া পরস্পরের সন্তানদের তাহারা আদর করিল। মন্দার মেয়েদের জন্য শ্যামা আনাইল খেলনা, শ্যামার ছেলেদের মন্দা জামা কিনিয়া দিল। একদিন তাহারা দেখিতে গেল থিয়েটার। টিকিটের দাম দিল মন্দা, গাড়ি ভাড়া ও পান লেমনেডের খরচ দিল শ্যামা। দুজনের এবার মনের মিলের অন্ত রহিল না। হাসিগল্প আমােদ আহ্লাদে দশ বারোটা দিন কোথা দিয়া কাটিয়া গেল। মন্দা আসলে লোক মন্দ নয়, শাশুড়ীর অতিরিক্ত শাসনে মেজাজটা আগে কেবল তাহার বিগড়াইয়া থাকিত। শ্যামা জীবনে কারো সঙ্গে এরকম আত্মীয়তা করার সুযােগ পায় নাই। মন্দার যাওয়ার দিন সে কাঁদিয়া ফেলিল। সারাদিন বাদুকে কোল হইতে নামাইল না, বাদুর লালায় তাহার গা ভিজিয়া গেল। মন্দাও গাড়িতে উঠিল চোখ মুছিতে মুছিতে।

 শুধু রাখালকে এবাব শ্যামার ভাল লাগিল না। জেলে না গিয়াও পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সময় মানুষের কয়েদীর মত স্বভাব হয়, সব সময় একটা গােপন করা ছােটলােকামির আভাস পাওয়া যাইতে থাকে। রাখালেরও যেন তেমনি বিকার আসিয়াছে। যে কয়দিন এখানে ছিল সে যেন কেমন ভয়ে ভয়ে থাকিত। কেমন একটা অপরাধীর ভাব, লােকে যেন তাহার সম্বন্ধে কি জানিয়া ফেলিয়া মনে মনে তাহাকে অশ্রদ্ধা করিতেছে। সে যেন তাই জ্বালা বোধ করিত, প্রতিবাদ করিতে চাহিত অথচ সব তাহার নিজেরই কল্পনা