পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

অনুভূতি, প্রতিবেশিনীদের ভিড়, বৌভাতের গোলমাল সব মিলিয়া তাহাকে একটু উদ্‌ভ্রান্ত করিয়া ফেলিয়াছিল। মামার কাছে ফিরিয়া যাওয়ার সময় সে শুধু সঙ্গে লইয়া গিয়াছিল কয়েকটা হৈ-চৈ ভরা দিনের স্মৃতি। ছ'মাস পরে এক আসন্ন-সন্ধ্যায় আবার এ বাড়িতে পা দিয়া চোখে সে দেখিয়াছিল অন্ধকার। একি অবস্থা বাড়ি-ঘরের? বাড়িতে মানুষ কই? লণ্ঠন দুটা ধোঁয়া ছাড়িতেছে, উঠানে পােড়া কয়লা ছাই ও হাজার রকম জঞ্জালের গাদা, দেয়ালে দেয়ালে ঝুল, পায়ের তলে ধূলাবালির স্তর! আর একঘরে মরমর একটা মানুষ।

 সে মন্দাকিনী।

 শীতল বলিয়াছিল, সব দেখে শুনে নাও। এবার থেকে সব ভার তোমার।

 বলিয়া সে উধাও হইয়া গিয়াছিল। বােধ হয় খাবার কিনিতে,—এ বাড়িতে রান্নার কোন ব্যবস্থা আছে শ্যামা তাহা ভাবিতে পারে নাই। সেইখানে, ভিতরের রােয়াকে তাহার ট্রাঙ্কটার উপর বসিয়া, ভয়ে ও বিষাদে শ্যামার কান্না আসিতেছে, এমন সময় সদরের খােলা দরজা দিয়া বাড়িতে ঢুকিয়াছিল লম্বা-চওড়া যােয়ান একটা মানুষ।

 সে রাখাল। মন্দাকিনীর স্বামী।

 এই রাখালের সাহায্য না পাইলে শ্যামা তাহার নূতন জীবনের সঙ্গে নিজেকে কিভাবে খাপ খাওয়াইয়া লইত জানিবার উপায় নাই, কারণ রাখালের সাহায্য সে পাইয়াছিল। শুধু সাহায্য নয়, দরদ ও সহানুভূতি। এতদিন রাখাল যে সব ব্যবস্থা করিতে পারিত কিন্তু করে নাই, এবার শ্যামার সঙ্গে সমস্তই সে করিয়া ফেলিল। প্রথমে বাড়িঘর সাফ হইল। তারপর আসিল কুকারের বদলে পাচক, ঠিকা ঝির বদলে দিবারাত্রির পরিচারিকা। হাটবাজার রান্নাখাওয়া সব অনেকটা নিয়মিত হইয়া আসিল।

 মন্দার চিকিৎসার জন্য রাখাল আরও পাঁচ ছয় মাস এখানে ছিল। সে সময়টা শ্যামার বড় সুখে কাটিয়াছিল। সে সময়মত স্নানাহার করে কিনা রাখাল সেদিকে নজর রাখিত, হাসি তামাসায় তাহার বিষণ্ণতা দূর করিবার চেষ্টা করিত, শ্যামার বয়সােচিত ছেলেমানুষীগুলি সমর্থন পাইত তারই