পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫২
জননী

অপরাধ নয়, এরকম দুষ্টামি ছেলেরা করেই। তবু মনটা শ্যামার খুঁত খুঁত করে। ছেলেকে সে নানারকম উপদেশ দেয়, অসংখ্য নিষেধ জানায়। কাজ করিতে করিতে হঠাৎ একটা কথা মনে পড়িয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে কাছে ডাকিয়া বলে, এ যেন তুমি কখনাে কোরাে না বাবা, কখখনো নয়।

 কেন মা?—বিধান বলে। প্রত্যেকবার।

 একদিন মন্দার একখানা পত্র আসিল, খুব দরদ দিয়া অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথা দিয়া লিখিয়াছে। চিঠি পড়িয়া শ্যামা মুখ বাঁকাইয়া হাসিল, বলিল, বসে থাক তুমি জবাবের জন্যে হা-পিত্যেশ করে, তােমার চিঠির জবাব আমি দিচ্ছিনে।—কদিন পরে শীতলের কাছে রাখালের একখানা পােস্টকার্ড আসিল, শ্যামা চিঠিখানা পুড়াইয়া ফেলিল, শীতলকে কিছু বলিল না। জবাব না পাইয়া একটু অপমান বােধ করুক লােকটা। ফাঁকি দিয়া টাকা বাগাইয়া লওয়ার জন্য শীতল তাহাকে এমন ঘৃণাই করিতেছে যে চিঠির উত্তরও দেয় না।

 ফাল্গুন মাস কাবার হইয়া আসিল। শীত একেবারে কমিয়া গিয়াছে। একদিন রােদ খাওয়াইয়া লেপগুলি শ্যামা তুলিয়া রাখিল। শ্যামার শরীরটা আজকাল ভাল আছে, তিন ছেলের মার আবার শরীর! তবু সানন্দে মনে আরেকটি সন্তানের সখ যেন উঁকি মারিয়া যায়, একা থাকিবার সময় অবাক হইয়া শ্যামা হাসে, কি কাণ্ড মেয়েমানুষের, মাগাে! বিধান দশটার সময় ভাত খাইয়া জুতা, মােজা, হাফপ্যাণ্ট আর সার্ট পরিয়া স্কুলে যায়, শ্যামা তাহার চুল আঁচড়াইয়া দেয়, আঁচল দিয়া মুখ মুছিয়া দেয়,—প্রথম প্রথম ছেলের মুখে সে একটু পাউডার মাখিয়াও দিত, বড়লােকের ছেলেদের মাঝখানে গিয়া বসিবে একটু পাউডার না মাখিলে কি চলে? স্কুলে ছেলেরা ঠাট্টা করায় বিধান এখন আর পাউডার মাখাইতে দেয় না। বলে, তুমি কিছু জানাে না মা, পাউডার দেখলে ওরা সবাই হাসে, সার শুদ্ধু। কি বলে জান?—বলে চূণ তো মেখেই এসেছিস এবার একটু কালি মাখ, বেশ মানাবে তােকে, মাইরি ভাই, মাইরি।

 মাইরি বলে? বিধানের স্কুলে বড়লােকের সােনার চাঁদ অভিজাত ছেলেদের মুখে এই কথাটির উচ্চারণ শ্যামার বড় খাপছাড়া মনে হয়। এমনি