পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী
৫৩

কত কথা বিধান শিখিয়া আসে, মাইরির চেয়েও ঢের বেশি খারাপ কথা। অনেক বড় বড় শব্দও সে শিখিয়া আসে, আর সঙ্কেত, শ্যামা যার মানেও বুঝিতে পারে না। তাহার অজানা এক জগতের সঙ্গে বিধান পরিচিত হইতেছে, অল্প অল্প একটু যা আভাস পায় তাতেই শ্যামা অবাক হইয়া থাকে। সে একটা বিচিত্র গর্ব ও দুঃখ বােধ করে। বাড়িতে এখন বিধানের জিজ্ঞাসা কমিয়া গিয়াছে, প্রশ্নে প্রশ্নে আর সে শ্যামাকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তােলে না। ছাদে উঠিয়া, খানিকদূরে বাঁধের উপর দিয়া যে রেলগাড়ি চলিয়া যায়, ছেলেকে তাহা দেখানাের সাধ শ্যামার কিন্তু কমে নাই, জ্ঞান ও বুদ্ধিতে ছেলে তাহাকে ছাড়াইয়া যাইতেছে বলিয়া গর্ব ও আনন্দের সঙ্গে শ্যামার দুঃখ এইটুকু।

 বকুল আছে।

 সে কিন্তু মেয়ে। ছেলের মত শ্যামার কাছে যেন অত খাতির নাই। ছ বছরের মেয়ে, সে তাে বুড়ী। শ্যামা তাহাকে দিয়া দুটি একটি সংসারের কাজ কবায়, মণিকে খেলা দিতে বলে, সময় পাইলে প্রথম ভাগ খুলিয়া একটু একটু পড়ায়। মেয়েটা যেমন দুরন্ত হইয়াছে সেরকম মাথা নাই, কিছু শিখিতে পারে না। তাহাকে অক্ষর চিনাইতেই শ্যামার একমাস সময় লাগিয়াছে, কতদিনে কর খল শিখিবে কে জানে। মাঝে মাঝে রাগ করিয়া শ্যামা মেয়ের পিঠে একটা চড় বসাইয়া দেয়। বিধানও মারে। প্রথম ভাগের পড়া যে শিখিতে পারে না তার প্রতি বিধানের অবজ্ঞা অসীম। এক একদিন সকালবেলা হঠাৎ সে তাহার ক্লাশ-মাস্টার অমূল্যবাবুর মত গম্ভীর মুখ করিয়া হুকুম দেয়, এই বুকু, নিয়ে আয় তো বই তোর—বুকু ভয়ে ভয়ে বই লইয়া আসে, তাহার ছেঁড়া ময়লা প্রথমভাগখানি। ভয় পাইলে বােঝা যায় কি বড় বড় আশ্চর্য দুটি চোখ বকুলের। পড়া ধরিয়া বােনের অজ্ঞতায় বিধান খানিকক্ষণ শ্যামার সঙ্গে হাসাহাসি করে, তারপর কখন যে সে অমূল্যবাবুর মত ধা করিয়া চাঁটি মারিয়া বসে, আগে কারো টের পাইবার যাে থাকে না। শ্যামা শুধু বলে, আহা খোকা, মারিস নে বাবা।

  বকুল বড় অভিমানী মেয়ে, কারাে সামনে সে কখনাে কাঁদে না; ছাদে চিলে কুঠির দেয়াল আর আলিসার মাঝখানে তাহার একটি হাতখানেক ফাঁক