পাতা:জননী - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

বিশেষ স্ত্রীটির যদি বয়স বেশি না হয়। স্বামী নানারকম সন্দেহ করিয়া বসে। কিন্তু রাখাল ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমান, চালাকিতে সংসারে শ্যামা তার জুড়ি দেখে নাই। যেসব আশ্চর্য কৌশলে শীতলকে সে সামলাইয়া চলিত, শ্যামাকে আড়াল করিয়া রাখিত, আজও মাঝে মাঝে অবাক হইয়া শ্যামা সে সব ভাবে। মন্দা সুস্থ হইয়া উঠিলে রাখাল তাহাকে লইয়া চলিয়া গিয়াছিল বনগাঁ। কলিকাতায় এত আপিস থাকিতে বনগাঁয়ে তাহার চাকরী করিতে যাওয়া শ্যামা পছন্দ করে নাই। একদিন, রাখালদের চলিয়া যাওয়ার আগের দিন, ওই কথা লইয়া রাগারাগিও সে করিয়াছিল। বয়স তাে শ্যামার বেশি ছিল না। জগতে কারো স্নেহে যে কারাে দাবী জন্মে না এটা সে জানিত না। আকুল আগ্রহে বিনা দাবীতেই স্বামীর চেয়ে আপনার লােকটিকে সে ধরিয়া রাখিতে চাহিযাছিল। রাখাল চলিয়া গেলে সে দু'চারদিন চোখের জল ফেলিয়াছিল কিনা, আজ, প্রথম সন্তানের মা হওয়ার পর, শ্যামার আর তাহা স্মরণ নাই। সমস্ত নালিশ সে ভুলিয়া গিয়াছে। সেই উদ্‌ভ্রান্ত দিনগুলিকে হয়ত সে রহস্যে ঢাকিয়া রাখিতে ভালবাসে, কারণ তাহাই স্বাভাবিক। যতই আপনার হইয়া উঠুক, রাখালকে শ্যামা একফোঁটা বুঝিত না, লােকটার প্রকাণ্ড শরীরে যে মনটি ছিল তাহা শিশুর না সয়তানের কোনদিন তাহা সঠিক জানিবার ভরসা শ্যামা রাখে না। তখন দ্বিপ্রহরে গৃহ থাকিত নির্জন, সন্ধ্যার পর দু'টি ভাঙ্গা লণ্ঠনের আলােয় বাড়ির অর্ধেকও আলাে হইত না। শীতল যেদিন রাত্রে দেরি করিয়া বাড়ি ফিরিত, দাওয়ায় ঠেস দিয়া বসিয়া তাহার প্রতীক্ষা করিতে করিতে নিয়মাধীন জীবনযাপন স্বভাবই শ্যামার কাছে অবাস্তব হইয়া উঠিত,— বয়স তাে তাহার বেশি ছিল না। সুতরাং রাখালকেও তাহার মনে হইত নির্মম, মনে হইত লােকটা স্নেহ করে, কিন্তু স্নেহের প্রত্যাশা মিটায় না।

 শীতলের তখন নিজের একটা প্রেস ছিল, মন্দ আয় হইত না। তবু, অভাব তাহার লাগিয়াই থাকিত। শীতলের মাথায় ছিট ছিল রকমারি, অর্থ সম্বন্ধে একটা বিকৃত উদাসীনতা ছিল তার মধ্যে সেরা। তাহার মনকে বিশ্লেষণ করিলে যােগাযােগ খুঁজিয়া পাওয়া যায় সন্দেহ নাই, কেবল, সে চেষ্টা করিবার মত অসাধারণ মানসিক বৈশিষ্ট ইহা নয়। টাকার প্রতি